প্রেমের খেয়া পর্ব ৪

#প্রেমের_খেয়া
#লেখিকা_জান্নাতুল_মীর
#পর্ব_৪

একটু আগেই সূর্য ডুবেছে। প্রচন্ড জোরে বাতাস বইছে।বাতাসের ঝাপটাই মালিক হাউজের বাড়ির প্রত্যেকটা জানলার পর্দা আপন মনে উড়ছে। হয়তো ঝড় আসবে।সেলিনা মালিক রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বাড়ির সব জানলা বন্ধ করে দিলেন।কাজের মেয়ে এসে জানালো সামরান অনেক্ষণ হলো বাসায় ফিরেছে। সেলিনা মালিক সামরানের রুমের দিকে পা বাড়ালো।

রকিং চেয়ারে বসে আছে সামরান।মাথা এলিয়ে দিয়েছে।চোখ জোড়া বন্ধ।মুখে মৃদু হাসি।বাতাসে সামরানের রুমের পর্দা গুলো এলোমেলো ভাবে উড়ছে।সামরানের সেদিকে খেয়াল নেই।সামরান অন্য এক জগতে ডুবে আছে।বার বার মায়ার বলা কথাগুলো মনে পড়ছে সামরানের। যত মনে পড়ছে ততই হাসির পরিমাণ বাড়ছে।মৃদু হাসি একসময় খিলখিল হাসিতে পরিণত হলো।বার বার কানে বাজছে মায়ার বলা শেষ লাইনটি,

“- “এক কথায় শ্যামবর্ণ মানেই আকাশ সমান ভালোবাসা যায় এমন এক মায়াবী পুরুষ”!! সামরান ফিক করে হেসে দিলো।চোখ জোড়া এখনো বন্ধ।নিচের ঠোঁটের এক পাশ কামড়ে ধরলো। সোজা হয়ে বসে মাথার চুল গুলো এক হাতে এলো মেলো করে দিলো সামরান।আশে পাশে আয়না খুঁজলো।কিন্তু আয়না তো নেই!সামরানের রুমে সামরান আয়না রাখেনি।এখন?ফোনের গ্লাসে নিজেকে দেখার অনেক চেষ্টা করলো সামরান।কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলো।নাহ এ দেখায় তৃপ্তি মিলছেনা। হুট করেই সামরানের মনে পড়ে তার মায়ের রুমে ড্রেসিং টেবিল আছে।সাথে সাথেই সামরান উঠে দাঁড়ায়।লম্বা পা ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে।

সামরান বেরিয়ে যাওয়ার সময় সেলিনা মালিক আড়াল হয়ে যায়।এতক্ষণ দাঁড়িয়ে সামরানের কান্ড দেখছিলো। সেলিনা মালিক কিছু বুঝতে পারছে না।হঠাৎ করে কি হলো সামরানের?সামরানের পিছু পিছু গেলো সেলিনা মালিক।সামরান সেলিনা মালিক এর রুমে প্রবেশ করেছে।ঢোকার সময় আশেপাশে একবার দেখে নিলো।কেউ আছে কি না?
সেলিনা মালিক আরো এক দফা অবাক হলেন।সামরান তো সেলিনা মালিক না থাকলে দুয়ার থেকেই ফিরে আসে।তাহলে আজ কি হলো?সেলিনা মালিক রুমের দরজায় এসে দাড়ালেন।সামরান আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।তা দেখে আবারো অবাক হলেন সেলিনা মালিক।

সামরান আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একটি বড় শ্বাস নিলো।তারপর দুহাতে চুল গুলো বার বার এদিক ওদিক করতে থাকে।কখনো এমন তো কখনো এমন!!সামরানের এহেন কান্ড দেখে সেলিনা মালিক হেসে দিলেন।পরক্ষণেই মুখ চেপে ধরলেন পাছে সামরান শুনতে পায়।
সামরান আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি কে গভীর ভাবে দেখতে লাগলো।তারপর এক হাতে নিজের মুখ স্পর্শ করে বললো,
“- নাহ আমি কুৎসিত নই। আমি দেখতে এতোটাও খারাপ নই।বলেই মৃদু হাসলো সামরান।

সামরানের কথা শুনে সেলিনা মালিক এর যেন প্রাণ ফিরে এলো।দেওয়ালের সাথে মাথা ঠেকিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে হেসে দেয় সেলিনা মালিক।
“-আমার পাথরের মত ছেলের এমন পরিবর্তন কে ঘটালো?যার মনে নিজের জন্য মায়া দয়ার চিহ্নটুকু নেই সেই ছেলে নিজেকে নিয়ে এত ভাবতে শুরু করলো?অবিশ্বাস্য!! সেলিনা মালিক আস্তে আস্তে রুমে প্রবেশ করলেন।তারপর মৃদু হেসে বললেন,
“-যেই মানুষ আমাদেরকে আমাদের সেই সত্ত্বার সাথে পরিচয় করায় যে সত্ত্বার আভাস আমরা কখনো কল্পনাও করিনি সেই মানুষ কে নিজের সামনে রাখতে হয়।নিজের কাছে।যাতে আমরা নিত্যনতুন ভাবে নিজেকে চিনি।যে আমাদের এটা ভাবতে বাধ্য করে যে আমরা তুচ্ছ নই।আমরা শ্রেষ্ঠ!! সেলিনা মালিকের কথা শুনে পেছনে ফিরে তাকালো সামরান।সেলিনা মালিক কে দেখে সামরান খানিকটা ইতস্ততবোধ করলো।মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো সামরান।সেলিনা মালিক মুচকি হেসে প্রশ্ন করলেন,

“-কে সে?যার জন্য জলন্ত অগ্নিকুণ্ড হুট করেই এত শান্ত হয়ে গেলো।তাপ এত সহজে কমে এলো..কার ছোঁয়ার ফল এটা?
সামরান সেলিনা মালিকের দিকে তাকালো। নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার মায়ের দিকে। সেলিনা মালিক মুচকি হেসে বললেন,
“- আমি মোবারক কে বলছি রুমে আয়নার ব্যবস্থা করতে।বলেই মৃদু হেসে রুম ছাড়লেন সেলিনা মালিক।সেলিনা মালিক চলে যেতেই সামরান আয়নার দিকে ফিরে তাকালো,
“-যার কথা বলার ধরন এতো সুন্দর না জানি সে দেখতে কত সুন্দর!!বলেই বাকা হাসি হাসে সামরান।

হরোর মুভি দেখছে মায়া।পাশেই বসে নকশিকাঁথা সেলাই করছে শেহনাজ।মায়া চিপস খাচ্ছে দৃষ্টি টিভির পর্দায় স্থির।
হঠাৎ করে স্ক্রিনে ভয়ংকর একটি চেহারা ভেসে উঠতেই মায়ার হাত থেকে চিপস পরে গেলো।বিকট এক চিৎকার দিয়ে শেহনাজের শাড়ি খামঁচে ধরে মায়া।
আচমকা এমন হওয়ায় শেহনাজের হাতে সুচঁ বিধে গেলো।শেহনাজ ভ্রু কুঁচকে রিমোট নিয়ে টিভি অফ করে দিলো।মায়া আস্তে আস্তে চোখ খুলে শেহনাজের দিকে তাকিয়ে হাসলো।
শেহনাজ কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইলো,

“-এসবে এতো ভয় পাস তারপরও কেন দেখতে হবে এসব ছাইপাশ!!
“-ছাইপাশ কোথায়?এটা তো মুভি।হেসে বলে মায়া।
“-শেহনাক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।মায়া শেহনাজের চাহনী দেখে জোর করে হেসে দিলো।তারপর আস্তে আস্তে পাশ থেকে উঠে চলে গেলো।মায়া যাওয়ার পর শেহনাজ হেসে দিলো।মেয়েটা এমনিতেই বড় হয়েছে।বাচ্চামো স্বভাব এখনো গেলো না।

রুমে গিয়ে বিছানায় পা তুলে বসে পড়লো মায়া। হঠাৎ ফোন বেজে উঠতেই তাড়াতাড়ি রিসিভ করলো।স্ক্রিনে রাহাদের নাম ভাসছে।হাসি মুখে ফোন রিসিভ করলো মায়া।
“-হ্যালো।ফিসফিস করে।
“-হাই!!কেমন আছো ম্যাডাম?
“-এইতো ভালো।তুমি কেমন আছো?
“-ভালোই আছি।কিন্তু তুমি এত ফিসফিস করে কথা বলছো কেন?
“-এমনি আমি কি চিৎকার করে কথা বলবো?
“-না না সেটা বলিনি।আইসক্রিম খাবেন?
“-খাওয়া যায়।বাট পাবো কোথায়?
“-বারান্দায় আসুন।
“-বারান্দায়?অবাক হলো মায়া।
“-হ্যা আসুন!!
“-আসলাম।বলেই বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায় মায়া।রাহাদ নিচে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে আইসক্রিম। মায়া হাসলো।রাহাদ আইসক্রিম ছুড়ে মারে মায়া আইসক্রিম ধরে নিল।তারপর রাহাদ ইশারা দিলো ফোন যাতে কানে ধরে।মায়া ফোন কানে ধরতেই রাহাদ বলে উঠলো,
“-আমি খাবো আর আমার ফ্রেন্ড খাবেনা তা কি হয়?তাই এটা তোমার।খাও আমি গেলাম।
“-থ্যাংক ইউ!!বলেই ফোন রেখে দিলো মায়া।

সিটি কলেজের সামনে এসে সামরানের গাড়ি থামলো।গাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা প্রিন্সিপাল এর রুমের দিকে অগ্রসর হলো সামরান। প্রিন্সিপাল সামরান কে দেখে খুশি আর অবাক দুটোই হলেন।সামরান প্রিন্সিপালের সামনে গিয়ে বসে।
“-স্যার আপনি হঠাৎ? হাসি মুখে বলে প্রিন্সিপাল।
“-আসলে একটা কাজে এসেছিলাম।
“-জ্বী বলুন কি কাজ?
“-আপনাদের কলেজ আমার ভালো লেগেছে।আই লাইক ইট।আমি চাই কাল পরশুর মধ্যে কলেজে একটি কম্পিটিশন হোক।
“-স্যার কেমন কম্পিটিশন?
“-কন্ঠস্বরের! মানে সব স্টুডেন্ট নিজেদের কন্ঠে গান,কবিতা বা নিজের পছন্দের বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে।তবে হ্যা সেটা পর্দার আড়ালে।যার ভয়েস আমাদের ভালো লাগবে তার জন্য থাকছে গিফট।এন্ড সেটা সয়ং আমি দেবো।এতে স্টুডেন্টদেরও ভালো হবে।আর কলেজের নাম বাড়বে।
“-স্যার এটা তো খুবই ভালো কথা।আমি সবকিছুর এরেঞ্জমেন্ট করি তাহলে।
“-মি.আহমেদ আমার একটা শর্ত আছে।
“-কি শর্ত স্যার?
“-কলেজের প্রত্যেকটি স্টুডেন্ট এই কম্পিটিশন এ অংশগ্রহণ করতে হবে বাধ্যতামূলক!! আর বিচারক আমি থাকবো।
“-ওকে স্যার আমি সব কিছুর ব্যবস্থা করছি।
“-থ্যাংক ইউ।বলেই চেক সাইন করে প্রিন্সিপাল কে দিলো।এটা আমার তরফ থেকে কলেজের জন্য।
“-থ্যাংক ইউ স্যার।প্রিন্সিপাল খুশিতে গদগদ হয়ে গেলেন।

সামরান বেরিয়ে আসে।গাড়ি অবধি এসে থমকে দাড়ালো।পেছনে ফিরে চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে একবার পুরো ক্যাম্পাস দেখে নিলো।তারপর হালকা হেসে গাড়িতে গিয়ে বসলো।

সামরানেএ ফার্মহাউজে বসে আছে হিয়া।সামরান এসে সোফায় বসে পড়ে।একটি দ্বীর্ঘশ্বাস ফেললো। হিয়া এগিয়ে এসে সামরানের পাশে বসতেই সামরান হিয়ার দিকে তাকালো।
“- কি ব্যাপার এত আপসেট কেন?
“-সামরান হিয়াকে একটানে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয় আর বলে,তোমাকে অপছন্দ করার কারণ কি জানো?
“-কি?
“-তুমি আমায় বুঝতে পারোনা।আমি আপসেট নই।আমি তো…..
“-বুঝতে চাই না আমি তোমায়। শুধু নিজেকে বিলীন করে দিতে চাই তোমার মাঝে।আর হারিয়ে যেতে চাই তোমার গভীরে।
“-সামরান এক আঙুল হিয়ার গালে স্লাইড করতে করতে বলে, একদিন সত্যি সত্যিই হারিয়ে যাবে কেউ খুঁজে পাবেনা।
“-না পাক তুমি পেলেই হলো।বলেই পেছনে ফিরে চুল গুলো সরিয়ে দেয় হিয়া।হিয়ার জামার চেইন সামরান খুলে ফেলে।চুমু দিলো হিয়ার পিঠে।হিয়া চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো।

সামরান আবারো ডুব দিলো তার পুরোনো তিক্ত নেশায়। নিত্যনতুন নারী সামরানের অভ্যাসে জড়িয়ে আছে। শত শত নারীর শরীরে সামরানের ছোয়া স্পষ্ট বিদ্যমান।তাদের অস্তিত্ব শুধু সামরানের বিছানা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। আর মন?সে তো অনেক আগেই কেউ একজন ডাস্টবিনে ময়লা ছুড়ে ফেলার মত ফেলে চলে গেছে।যার কারণে সামরানের এই অবস্থা।নিজেকে বদলে নিয়েছে সামরান।এক নারীর প্রত্যাখানে সামরান শত শত নারীকে বিছানায় নিয়ে যেতে বাধ্য করেছে।একজনের প্রত্যাখান এ সামরান নিজের উপর ঘৃণা করতে শিখেছে।নিজেকে কুৎসিত বলে মস্ত বড় উপাধি দিয়েছে সামরান।

সিমি অনেক কষ্টে রান্না ঘরে গেলো।শেহেরজাদ এর জন্য খাবার বানাতে হবে।ঘুম থেকে উঠে সিমিকে পাশে না পেয়ে শেহেরজাদ উঠে নিচে নেমে আসে।সিমির নাম ধরে চিৎকার করতে থাকে।
“-সিমি!!সিমিইইইই!সিমিই!
শেহেরজাদের আওয়াজ শুনে সিমি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসলো।সিমি কে দেখে শেহেরজাদ দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো।টাল সামলাতে না পেরে সিমি ডিভানে পড়ে যায়।শেহেরজাদ মাথা তুলে সিমিকে জড়িয়ে ধরলো।
“-কি হলো আপনার?আমি আছি তো। কোত্থাও যাইনি।
“-আমাকে না বলে কেন নিচে এসেছো তুমি।মাথা তুলে সিমির দিকে তাকিয়ে বলে শেহেরজাদ।
“-খাবার এর জন্য।
“-আমার খাবার চাই না।তুমি আমার পারমিশন ছাড়া নেমে এলে কেন?
“-সরি আমি বুঝতে পারিনি।
“-এর জন্য পানিশমেন্ট তো পেতেই হবে বেইবি।কাম অন।বলেই উঠে সিমিকে কোলে তুলে নিলো।
সিমির ভেতরটা কেঁপে উঠলো। আবার কি করবে শেহেরজাদ? কালকের ব্যাথা এখনো যায়নি আবার?

শেহেরজাদ সিমিকে বিছানায় রেখে দরজা বন্ধ করে ফিরে তাকালো।সিমি অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে রইলো।
“-সরি শেহের!আমি আস…
“-সিমির মুখে আঙুল ঠেকিয়ে থামিয়ে দেয় শেহেরজাদ।হুসসসস!!নো মোর এ সিঙ্গেল ওয়ার্ড।আই নিড ইউ।রাইট নাউ!!সিমি ভয়ে ঢোক গিললো।শেহেরজাদ সিমির ঘাড়ের চুল সরিয়ে চুমু দিলো।তারপর নেশাক্ত কন্ঠে বললো,
“-তোমার পানিশমেন্ট এটাই। আই হোপ ইউ ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড?
“-সিমি আবারো ঢোক গিললো।নিঃশ্বাস এর মাত্রা বেড়ে গেছে সিমির।ঘন হয়ে এসেছে নিঃশ্বাস। শেহেরজাদ পরম আদরে আবারো কাছে টেনে নিলো সিমিকে।ভালোবাসার উষ্ণ ছোয়া পেয়েও সিমি কেঁদে চলছে।শেহেরজাদের স্পর্শ যেন কাটা বিধে যাওয়ার মক্ত যন্ত্রণা দিচ্ছে।নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিতে থাকে সিমি।শেহেরজাদ সিমির মাঝে ডুবে ছিলো যার কারণে সিমির চোখের পানি শেহেরজাদের নজরে পড়লো না।যন্ত্রণার কারণ যখন ভালোবাসার মানুষ হয়,তখন তার ছোঁয়া বিষের চেয়ে বিষাক্ত হয়।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here