#তোমার_মনের_মধ্যিখানি 🌼
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
#পর্ব_৮
একা রাস্তায় শান্ত কে গালাগাল করতে করতে হেঁটে যাচ্ছে নিঝুম! হঠাৎ করেই একটা বাইক এসে থামল তার সামনে! নিঝুম থমকে দাঁড়িয়ে গেল। হাত মুঠো করে নিল সে। রাস্তার মাঝে শুধু একা সেইই দাঁড়িয়ে! এই ভর সন্ধ্যায় কে এলো এখানে!
বাইকের হেলমেট খুলে নিঝুমের দিকে ফিরল আহনাফ! নিঝুম অবাক চোখে আহনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। আহনাফ কিঞ্চিত হেসে বাইক ছেড়ে উঠলো। নিঝুম স্থির চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে! আহনাফ হেসে জিজ্ঞেস করল,
“কেমন আছো?
“হুম!
“জিজ্ঞেস করছি কেমন আছো!
ঘোর ভাঙল নিঝুমের। চট করেই বলে উঠল,
“হুম ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
আহনাফ হাসল। জবাব না দিয়ে ওদিকে তাকিয়ে বলল,
“আইসক্রিম খাবে!
নিঝুম চোখ ফিরিয়ে তাকাল। দূরেই একটা আইসক্রিম পার্লার দেখা যাচ্ছে। আহনাফ নিঝুমের দিকে ফিরতেই নিঝুম মুচকি হাসল।
নিঝুমের হাতে একটা আইসক্রিম। আহনাফ দুই হাত প্যান্টের প্যাকেটে দিয়ে বলল, হাতে কি খুব বেশি ব্যাথা!
নিঝুম আইসক্রিম মুখে দিয়ে মাথা নাড়িয়ে বলল, না! আইসক্রিম খাবার খুশিতে হাতের ব্যাথা চলে গেছে।
আহনাফ হাসল। নিঝুমের সেদিকে খেয়াল নেই। নিজের মনে দাড়িয়ে খুশিতে আইসক্রিম খাচ্ছে সে। আগের আইসক্রিম টা অশান্ত’র জন্য খেতে পারি নি মনে খুব দুঃখ ছিল। সেই দুঃখ এবার কমেছে। আহনাফ ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে তার খাওয়া দেখছে। হালকা কেশে আহনাফ বলে উঠে,
“আজ শান্ত তোমাকে বেশ খাটিয়েছে!
“শুধু খাটিয়েছে! আপনি জানেন উনি কি কি করেছে। শুনুন, আমাকে নিয়ে পুরো মল ঘুরিয়েছে। পুরো তিন বছরের কেনাকাটা আজ একদিনেই করেছে। বুঝলেন সব হচ্ছে আমাকে জ্বালানোর ধান্দা। জব্দ করার ধান্দা।
“তাহলে তুমি ওর সামনে যাও কেন?
“আমি যায়নি তো, উনিই জানি কোথা থেকে উড়ে চলে আসে।
“ওর ভয়ে আজ ভার্সিটিতে আসো নি নাহ!
আইসক্রিম খাওয়া বন্ধ করে আহনাফের দিকে ফিরে মুখ টিপে হাসলো নিঝুম। আহনাফও হেসে দিল ওর সাথে। নিঝুম বলে উঠল,
“আমি তো ভেবেছিলাম ৩ সপ্তাহ যাবো না।
“তিন সপ্তাহ! এতো দিন।
“হুম হুম। এই অশান্ত’র রাগ ঝড়ে যাবার জন্য ৩ সপ্তাহ ঠিক ছিল।
“অশান্ত!
“হুম হুম। উনি একটা অশান্ত। আসলে অশান্ত না বলে অশান্তি বলা দরকার। অশান্তির মূল উনি!
আহনাফ জোরে হেসে দিল। নিঝুম আইসক্রিম খাওয়া বন্ধ করে আহনাফের হাসির দিকে তাকিয়ে থাকল। হাসির শব্দ কানে বাজছে তার। আহনাফ থেমে বলল,
“তুমি পারেও বটে। কোন ধারণা নেই তোমার। যদি শান্ত এসব জানতে পারে তাহলে তোমার কি করবে?
“কচু করবে? উনাকে ভয় পাই নাকি আমি।
“তাও ঠিক! ( কাছে এসে নিঝুমের মাথায় হাত রেখে বলে ) অনেক সাহসী তুমি!
নিঝুম মুচকি হাসল। লজ্জায় তার দু গাল লাল হয়ে যাচ্ছে। আহনাফ বাইকের হেলমেট পড়তে পড়তে বলে,
“তো বাসায় ফিরবে তো!
নিঝুম মাথা নাড়িয়ে বলে, “এই তো এখান থেকে ৫ মিনিটের পথ। আমি একাই যেতে পারবো
“ঠিক তো!
নিঝুম মাথা নাড়ল। অতঃপর আহনাফ বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে গেল সেখান থেকে। নিঝুম আইসক্রিম খাবার ধান্দায় এতোক্ষণে কি বলল এখন সেটাই ভাবতে লাগল। আহনাফ চলে গেছে। যাবার আগে “ঠিক তো” জিজ্ঞেস করেছিল। এর মানে কি? তবে কি আহনাফ নিজের বাইকে করে তাকে নিয়ে যেত। এটা তার মাথায় আসতে এতোক্ষণ লাগল। রেগে এখন নিজের মাথার চুল নিজের’ই ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে তার। চোখ বন্ধ করে দুই পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করছে। ইশ! কিভাবে পারল ও না করতে। আহনাফের বাইকে উঠে তার সাথে যেতে পারতো। আআআআআ! কতোটা না ভালো লাগতো। নিঝুম! তুই আসলেই গাধির নাতনি! নাহলে এতোবড় বোকামি কিভাবে করলি তুই। কিছু হবে না তোর দ্বারা কিছু না।
এক বস্তা দুঃখ নিয়ে আইসক্রিম খেতে খেতেই পা বাড়াল বাড়ির দিকে। এই রাস্তাটা এখন একাই যেতে হবে তার। সুযোগ তো ছিল’ই , আহনাফ জিজ্ঞেস ও করেছিল কিন্তু না তো সেইই করেদিল!
—–
আহনাফের বাইকে চড়তে না পারার আক্ষেপ এখন অবদি রয়ে গেল নিঝুমের। টেবিলে বসে পড়ার বদলে সেই কথাই এখন ভাবছে সে। ভাবতেই রাগ হচ্ছে। আর রাগ হতেই নিজের চুল নিজেই টানছে। হিনা এসে এসব দেখে ভ্রু কুঁচকে কতোক্ষণ তাকিয়ে রইল। অতঃপর মার ঘরের দিকে যেতে যেতে চেঁচিয়ে বলল, মা মা তোমার বড় মেয়ে পাগল হয়ে গেছে। নিজের মাথার চুল নিজেই টানছে।
নিঝুমের মা অবাক কন্ঠে বলে, “কি বললি?
“হ্যাঁ গো মা, সত্যি বলছি।
নিঝুমের মা অবাক হয়ে ডেসিন টেবিলের দিকে তাকালেন।
খানিকক্ষণ পর নিঝুমের ঘরে এলো তার মা। টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে নিঝুম। মা এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, কিরে তোর কি হয়েছে?
“কিছু না!
“শুনলাম নিজের চুল নিজে টানছিস!
“হুম।
“কেন?
“এমনেই ভালো লাগছে না।
“ভালো লাগবে কিভাবে? চুলের যেই হাল, একটু তেল পানি দিস। তেল দিলে চুল ভালো থাকবে। চুল ভালো থাকলে মাথা ভালো থাকবে আর মাথা ভালো থাকলে..
“উফ মা থামো তো। বচন শুরু করো না।
“বচন শুরু করছি না। শেষে কবে মাথায় একটু তেল দিয়েছিল বল তো। চুলের যেই হাল, এখন’ই পড়তে শুরু করেছে। বলি কি আমরা যখন বিয়ে করেছিলাম তখন আমাদের কি চুল ছিল। দেখার মতো।
“তাহলে এখন সব কোথায়?
“ঝড়ে গেছে। তোর জন্মের পর আস্তে আস্তে সব চুল ঝড়ে গেছে।
“বেশ হয়েছে। আমিও তোমার মতোই হচ্ছি।
“না, হচ্ছিস না। তাও তো বিয়ের সময় আমার ঘন চুল ছিল তোর তো এখন থেকেই নেই। এরপর বিয়ে শাদির পর তো মাথায় টাক পড়ে যাবে।
“মা শোন, চুল ঝড়বে আমার গজাবে।
“কিভাবে গজাবে। যত্ন না নিলে কিভাবে গজাবে
“কেন গাছের যত্ন না নিলেও গাছ জন্মায়, জন্মায় না।
“গাছ মাটিতে পোতা হয় আর তোর যেই মাথা, এটাতে গোবর ছাড়া আর কিছু নেই।
“মা গোবর এক ধরণের সার!
“চুপ কর তুই। খালি মুখে মুখে তর্ক। এখানে আয় বস!
“আম্মু না,আমি চুলে তেল দেবো না।
“দিতে হবে, এই বয়সেই ভাল লাগেনা রোগ ধরেছে। হুহ কথার কি ছিড়ি!
“আহ!
মা নিঝুমের চুল টেনে টেনে তেল পাকিয়ে দিচ্ছে। নিঝুম মুখ গুমড়ে বসে আছে। এভাবেই তার কাছে অশান্তি তার মধ্যে মাথায় তেল দেবার অবস্থা। ইচ্ছে করছে কোন পুকুরে খানিকক্ষণ ঢুব দিয়ে বসে থাকতে!
ভোর সকালে উঠে গোসল করল নিঝুম। কারণ একটাই মাথার এই শ্যাম্পু! যদিও রাতে তার ঘুম ভালোই হয়েছে তবুও এই তেল দেওয়া মাথায় তো আর ভার্সিটিতে যেতে পারে না সে। অতঃপর ভার্সিটির উদ্দেশ্য বাসা থেকে বের হলো নিঝুম। বের হতেই হঠাৎ করে সামনে এসে দাঁড়াল হিনা। অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,
“তুই না তিন সপ্তাহ পর যাবি ভার্সিটিতে!
নিঝুম অসহায় দৃষ্টিতে চোখের চশমা ঠিক করে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, যার ভাগ্যে আগে থেকেই সবকিছু ঠিক করা তার কোন কথাই ফলে না রে।
“মানে!
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কিছু না!
পাশ বেরিয়ে চলে গেল সে। হিনা দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করল হয়েছে তো হয়েছেটা কি!
ভার্সিটিতে এসেই মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। গ্যাং ডেভিলের কারোট সাথে দেখা হয় নি তার ব্যতিক্রম আহনাফ। যদিও আহনাফ কে দেখেই তার মন ফুরফুরে! দূরে বেঞ্চিতে বসে বই পড়ছে আহনাফ। নিঝুম দূর থেকেই দেখছে তাকে। হায়! গতকাল তাকে আইসক্রিম কিনে দিয়েছে সে। এটা ভাবতেই গাল দুটো লাল হয়ে গেল। বির বির করতে লাগলো নিজের মনেই,
“কেন এতো কিউট ও কেন? কত্তো সুইট! কিন্তু খারাপ একটাই গ্যাং ডেভিলের সদস্য! কি করে যে হয় এমনটা বুঝতে পারি না। তার সাথে কি এসব মিল খায়। সবচেয়ে বড় অমিল তো ওই অশান্ত! কিভাবে বেস্ট ফ্রেন্ড হয় তারা। আকাশ পাতাল তফাৎ! জলে আর পানিতে তো মিশ খায় না, কিন্তু এখানে খেল কিভাবে?
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করেই থেমে গেল সে। কারণ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে কেউ! নিঝুম চোখ তুলে তাকিয়ে দেখল আহিম। আহিম তাকে দেখে মুখ টিপে হাসছে। তার হাসি দেখে নিঝুম ও দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলল,
“হাসছেন কেন?
আহিম হাসি থামিয়ে, “তা শেষমেষ এসেই পড়লে ভার্সিটিতে!
“কেন আসবো না কেন?
“না গতকাল যা হয়রানি করল এরপর যে আসবে এটা ভেবেই অবাক লাগছে।
“অবাক লাগলে অবাক হোন!
বলেই পাশ দিয়ে যেতে নিল। তখন আহিমের একটা কথা কানে এলো তার! “বিড়ার চশমিশ! এটা শুনেই থেমে গেল সে। চশমিশ তো সে! না মানে চশমিশ না , এটা ওই অশান্ত ডাকে! কিন্তু বিড়াল যোগ হলো কবে থেকে! ভাবতে ভাবতে এবার ক্লাসের দিকে পা বাড়াল। তখনই খুব জোরে তার হাতে বাড়ি মারল কেউ। নিঝুম কেঁপে তাকিয়ে দেখল ইফা আর তিথি দাঁড়ানো! নিঝুম হেসে বলল,
“হাই!
“হাই!
ইফাও হেসে বলল, হুম হাই! কোথায় উধাও হলি সেদিন।
তিথি বলে উঠল, শুনলাম শান্ত’র সাথে ছিলি।
নিঝুম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, দু্ঃখের কথা মনে করিয়ে দিস না প্লিজ!
“মানে, কি হয়েছে?
“বলছি ক্লাসে চল!
“না ক্লাসে যাবো না!.
“কেন?
তিথি নিঝুমের হাত ঘুরিয়ে বলল, শুধু শুধু লেকচার শুনে কি লাভ বল তো। কি হবে এসব শুনে!
নিঝুম হাত ছাড়িয়ে বলল, তাই তো! তোর তো বিয়ে বিয়ে করে। বিয়েটা করে ফেললেই তো কাহিনী শেষ!
“দোয়াও তো করতে পারিস, তাহলে অবশ্য একটা দাওয়াত পাবো।
ইফা তিথির ঘাড়ে হাত রেখে বলে, হুম তাই তো!
নিঝুম এসব শুনে মুখ ভেংচি কাটলো!
——
ক্যান্টিনে তিন জন বসে একসাথে আড্ডা দিচ্ছে। তখনই সেখানে তানিশা’র দল এলো। নিঝুম তানিশা’র দিকে একবার তাকাল। কিন্তু তানিশা কে আজ একটু অন্যরকম অন্যরকম লাগল তার কাছে। কারণ তানিশা তার দিকে ফিরল না। দূরে এক টেবিলে বসল তারা। তিথি বলে উঠল, চল আমরা এখান থেকে চলে যায়!
ইফাও মত দিল। নিঝুম উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তোরা যা, আমি একটু ওয়াশরুম থেকে আসছি।
“জলদি আসবি, ওরা কিন্তু এখানেই আছে!
নিঝুম মাথা নাড়ল। কিন্তু তার মনে হচ্ছে তানিশা হয়তো সবকিছু্ই ভুলে গেছে। কিন্তু তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো তখন যখন ওয়াশরুম থেকে বের হতে যাবে তখনই তানিশা তাদের দল এসে ঢুকল। নিঝুম তবুও পাশ দিয়ে যেতে নিল তখন’ই দিয়া তার বাহু ধরে জোরে ধাক্কা দিয়ে সামনে আনল। নিঝুম ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। সামনে এসে দাঁড়াল তানিশা। দুই হাত বাহুতে গুঁজে তাকিয়ে রইল নিঝুমের দিকে। নিঝুম তাকিয়ে আছে তার’ই চোখের দিকে। একটিবারের জন্যও চোখ সরাচ্ছে না নিঝুম। তানিশা হেসে নিঝুমের থিতুনি তে হাত রেখে বলল, সিনিয়রদের চোখ রাঙানি দিচ্ছ!
“আমাকে এখান থেকে যেতে দাও!
“কি? কি বললে তুমি!
“আমাকে এখানে আটকে কেন রেখেছ, যেতে দাও!
তানিশা জোরে বলে উঠল, গলা নামিয়ে কথা বল! কার সাথে উচু গলায় কথা বলছো তুমি!
তানিশা’র ধমক শুনে খানিকটা থমকে গেল নিঝুম। এর মাঝেই বাইরে থেকে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে গেল দরজার সামনে। দরজা ভেতর থেকেই বন্ধ করা। নিঝুম ঢোক গিলে বলল, আমি তো এবার কিছু করে নি। তাহলে আমার সাথে এমন করছো কেন?
“এখন তো করো নি আগে তো করেছ? কি তাই নয় কি? ভুলে গেছো সেদিনের কথা। আহনাফ হাত ধরেছিল তোমার? আহ! কিভাবে?
“আমি তো বলে নি হাত ধরতে!
“ন্যাকা সাজছো? আমার কাছে ন্যাকা সাজছো। দোষ ছিল না তোমার। দেখি তো সারাক্ষণ এসে আহনাফের কাছেই ঘোরাঘুরি করো। কি করো না!
“আমি কিছু করেনি আমাকে যেতে দাও!
তানিশা এবার জোরে হেস উঠলো। তার হাসির সাথে তাল মিলায় লাগল দিয়া আর রিয়া। তানিশা হাসতে হাসতে বলল, শুনলি! ও কিছু করেনি। কিছু করেনি ও। তাহলে এভাবে ওকে আটকে কেন রেখেছিস। যেতে দে! যেতে দে ওকে?
দিয়া আর রিয়া সরে গিয়ে পথ দেয় নিঝুম কে। নিঝুম কাঁধের হাতের বইটা কে শক্ত করে ধরে সেখান থেকে চলে যেতে নেয়। তখন’ই তানিশার ইশারায় দিয়া আর রিয়া হঠাৎ করেই তার বাহু ধরে ফেলে! নিঝুম এমন কিছু হওয়াতে অবাক হয়ে যায়। ছোটাছুটি শুরু করে দেয় সে। কিন্তু এই দুজনের শক্তিতে পেরে উঠে না সে। নিঝুম তানিশার দিকে দাঁতে দাঁত চেপে তাকিয়ে থাকে। তানিশা হেসে নিঝুমের বইটা নিচ থেকে নিয়ে বলে, ভাঙবে তবু মচকাবে না। এখনো আমার দিকে চোখ রাঙাচ্ছো তুমি!
“আমি কিন্তু চেচাবো। ছাড়ো আমায়!
“তাই নাকি? নেও চেচাও?
নিঝুম ঘন ঘন শ্বাস নিতে লাগল। চেঁচাতে শুরু করল সে। বাঁচাও বাঁচাও করে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। বাইরের সবাই তার চেঁচামেচি শুনছে কিন্তু কেও পা এগিয়ে সামনে আসছে না। আরো পিছিয়ে যাচ্ছে। তানিশা হেসে উঠে। নিঝুম থেমে যায়। তানিশা হেসে বল,
“কোথায়? কারোই তো কথা শুনছি না আমি! কেউই আসছে না তোমাকে বাঁচাতে।একা একা কিভাবে বাচবে তুমিও। এভাবে চোখ রাঙিয়ে!
নিঝুমের রাগ হচ্ছে! ছোটাছোটি করছে অনেক তবু কোনভাবেই পেরে উঠছে না সে। আবারো চেঁচাতে লাগল সে। দিয়া বলে উঠে,
“আর কানের পোকা বের করে দেবে এই মেয়ে!
তানিশা হেসে নিঝুমের বই খুলছে! নিঝুম বলে উঠে,
“এই কি করছো তুমি? আমার বই খুলছো কেন? শোন আমাকে ছেড়ে দাও। নাহলে আমি কিন্তু প্রিন্সিপালের কাছে গিয়ে বিচার দেবো তোমাদের নাম..
বলার আগেই তানিশা বইয়ের পৃষ্ঠা ছেড়ে তা মুখে পুড়ে দেয় নিঝুমের। নিঝুম উমম উমম করে যাচ্ছে। এখন আর কথা বলতে পারছে না। তানিশা হেসে নিঝুমের গাল চেপে ধরে বলে, কারো কাছে বিচার দিয়েই কোন লাভ হবে না তোমার। সবাই চাইবে প্রুফ! কে দেবে সেই প্রুফ তুমি নাকি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো। কেউ দেবে না কেউ না!
নিঝুম রাগে ফুঁসছে। ছোটছোটির করছে তার সব শক্তি দিয়ে। এদিকে রিয়া আর দিয়া ঠিক ততোটা জোর দিয়েই ধরে রেখেছে তাকে। তানিশা রেগে নিঝুমের চুলের মুঠি ধরল। ব্যাথায় চুপ হয়ে গেল নিঝুম। তানিশা নিঝুমের দিকে চোখ রাঙিয়ে বলল, চুপ! একদম চুপ। বেশি ছটফটানি করবে না। যত ছটফটাবে ততোটাই কষ্ট পাবে। আমি তোমাকে আজ শুধু ওয়ার্নিং দিতে এলাম। এরপর কখনো যেন তোমাকে আমার আহনাফের ধারে কাছে না দেখি! যদি দেখি তাহলে আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না। আর এখন তো বুঝেই গেলে আমি ঠিক কতোটা খারাপ। কি কি করতে পারি তোমার সাথে!
নিঝুম চোখ নামিয়ে ফেলল এবার। চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে তার। এদিকে নিঝুমের আসতে দেরি হওয়ায় ইফা আর তিথি এসে হাজির। এখানে এসে দেখল ভিড় হয়ে আছে। ভেতরে কিছু একটা হয়েছে আন্দাজ করতে পেরে দুজনেই দরজা ধাক্কাতে থাকে। তানিশা হেসে বলল, নাও! এসে পড়েছে তোমার বান্ধবী গন!
দিয়া আর রিয়া হেসে ছেড়ে দিল নিঝুম কে। তানিশা নিঝুম কে ছেড়ে দিয়ে ফেলে দিলো মেঝেতে। মেঝেতে পড়ে গেল নিঝুম। মুখ থেকে কাগজ গুলো বের করে ঘন ঘন শ্বাস নিতে লাগল সে। তানিশার হাসির আওয়াজ পেয়ে উপরের দিক তাকাল। তানিশা হেসে বলল, আমার কথা মনে রেখো কিন্তু। এরপর যাতে আর কিছু বলতে না হয় আমার!
বলেই দরজা খুলে বের হলো তারা। মেঝেতে পড়ে থাকা নিঝুম হাত দিয়ে চোখের অশ্রু মুছে! ইফা আর তানিশা মুখোমুখি! তানিশা তাকে রেখে বাঁকা হেসে বের হয়ে যায়। ইফা আর তিথি ছুটে ভেতরে এসে নিঝুমের এই হাল দেখে চমকে উঠে!
#চলবে….
#তোমার_মনের_মধ্যিখানি 🌼
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
#পর্ব_৯
[
ইফা আর তিথি ছুটে ভেতরে এসে দেখে নিঝুম মেঝেতে বসা। থেমে থেমে নিঝুমের নাম নেয় ইফা। নিঝুম চোখ তুলে তাকায় ইফার দিকে। তার চোখে অশ্রু জলজল করছে। চোখ নামিয়ে ফেলে নিঝুম। দরজার বাইরে থেকে উঁকি ঝুঁকি মেরে দেখছে সবাই। কারো থেকে কারো আগ্রহ কম না। নিঝুম উঠে দাঁড়ায়। কাঁধের ব্যাগ টা হাতে নেয় সে। ইফা আর তিথি এসে দাঁড়ায় নিঝুমের সামনে। কি বলে সান্তনা দেবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। তিথি ঢোক গিলে হাত রাখে নিঝুমের ঘাড়ে। নিঝুমের চোখের কার্নিশ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। মুহুর্তেই ছুটে বের হয়ে আসে নিঝুম। দৌড়ে বের হয়ে আসে সেই ভার্সিটি থেকে। সবাই দাঁড়িয়ে তার বের হয়ে যাওয়া দেখছে। ইফা আর তিথিও দৌড়াতে থাকে। কিন্তু ভিড়ের মাঝে হারিয়ে ফেলে নিঝুম কে!
শান্ত আর আফিন কথা বলতে বলতে ক্যাম্পাসের দিকে হাঁটছিল। এর মাঝেই হুট করে নীলাভ্র এসে দাঁড়ায় শান্ত’র সামনে। একটু দূরেই ছুটে যাচ্ছিল নিঝুম! কিন্তু তা আড়াল হয়ে যায় শান্ত’র চোখ থেকে কিন্তু আড়াল হতে পারে না আহনাফ’র চোখে থেকে। বইয়ের চোখ থেকে দৃষ্টি সরে যায় তার। কাঁদতে কাঁদতে নিঝুম কে ছুটে যেতে দেখে সে। ডাকতে ইচ্ছে হলেও যেন তার সুযোগ করে উঠতে পারে না। অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকে সে। কি হয়েছে বোঝার চেষ্টা করে শুধু!
পার্কে একা বসে কাঁদছে নিঝুম। কোন কিছু ছাড়াই খুব অপদস্থ হতে হয়েছে তাকে। সত্যি’ই কি কোন দোষ ছিল তার। চোখের চশমা খুলে চোখের অশ্রু মুছতে সে। কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠে,
“কেউ ভালো না, এই তানিশা রিয়া দিয়া ওরা কেউ ভালো না। কতোটা খারাপ! সিনিয়র রা সবসময় খারাপই হয়। তার মনে আছে কলেজে পড়া অবস্থায় একটা মেয়েকে সিনিয়র’রা খুব খারাপ অবস্থা করেছিল। মেয়েটা সেদিন কাঁদতে কাঁদতে তার পাশ বেয়ে গেছিল। সেদিনও সারা রাত কেঁদেছিলো নিঝুম। তার কষ্ট বুঝতে না পেরেও কেঁদেছিলেন তাই আজ তার কষ্ট বেশি। ঠিক হারে হারে বুঝতে পারছে কতোটা কষ্ট পেয়েছিল ও। আজ তার কোন অংশেই কম পায়নি সে। কোন মতেই সিনিয়রদের সাথে পেরে উঠা যায় না। কিভাবে যাবে, একা একজন সে কিভাবে পারবে ওদের সাথে। ইফা কতোদিন বাঁচাবে তাকে কিংবা আহনাফ কতোদিন সান্ত্বনা দেবে। রোজ রোজ কে ভোগ করবে এসব। না আর না!
চোখের জল মুছে ছেড়া বই টা হাতে নিল নিঝুম। কয়েকটা পাতা ছেঁড়া দেখেই রাগে তার ঠোঁট কাঁপতে লাগলো। চোখ বন্ধ করতেই সেই ভয়ানক অবস্থার কথা। শরীর কেঁপে উঠলো তার। শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। ঘন ঘন শ্বাস নিতে লাগল। না আর না, এরপর আর কখনো গ্যাং ডেভিল’র কারো সাথে লাগবে না। তানিশা’র যখন পছন্দ না তখন আর আহনাফ’র সাথে মিশবে না। শান্ত’র থেকেও দূরে দূরে থাকবে। মন হার গেছে কিন্তু তাই বলে সব সহ্য করবে তাও না। আহনাফের থেকে দূরে থাকার পর কেউ কিছু বলতে এলে ঘুসি দিয়ে তার নাক পাঠিয়ে দেবে। হুহ! এই এখন মনে হচ্ছে আমি নিঝুম! সবকিছু এতো সহজে সহ্য করবো না কখনো না। সিনিয়র বলে বারণ করেছে কথা বলতে মেনে নিয়েছি সব মেনে নেবো এমনটা না হুহ!
হঠাৎ পাশ থেকে মেয়েলী কন্ঠ ভেসে এলো। কন্ঠটা চেনা চেনা লাগছে তার। দ্রুত চশমা পড়ে তাকিয়ে দেখল হিনা দুই হাত দিয়ে কাঁধের ব্যাগ ধরে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে তার দিকে। নিঝুম ফিক করে হেসে দিয়ে বলল,
“তুই এখানে!
“আমি এখানে ঠিক আছে কিন্তু তুই এখানে কেন?
“তুই যেই কারণে আমিও সেই কারণে। কিন্তু তোর স্কুল ছেড়ে এখানে কি করছিস!
“এখন স্কুল ছুটি তাই এখানে।
“এতো তাড়াতাড়ি!
“আজ বৃহস্পতিবার!
“ওহ আচ্ছা, চল বাসায় চল।
বলেই উঠে দাঁড়ায় নিঝুম। হিনা আড় চোখে তাকায় নিঝুমের দিকে। বলে উঠে,
“তুই কাদছিলো আফা, কিছু কি হয়েছে?
“না কি হবে? আর আমি কাঁদছিলাম এটা তোকে কে বলল?
“তোর চোখ!
নিঝুম ফিক করে হেসে উঠে। হিনা’র কাঁধে হাত রেখে বলে,
“আইসক্রিম খাবি!
কথা ঘোরানোর ব্যাপারটা বুঝতে পারে না হিনা। আইসক্রিম’র কথা শুনে দৌড়ে কাছের দোকানের কাছে ঢুকে পড়ে সে। নিঝুম দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকিয়ে থাকে তার দিকে!
——–
পুরো ভার্সিটি খোঁজা শেষ শান্ত’র! কিন্তু এখন অবদি চশমিশ কে চোখে পড়ল না তার। গতকাল বলার পরও আজও আসেনি এটা ভেবেই রাগ বাড়ছে শান্ত’র। ঠোঁট কামড়ে চশমিশ’র ক্লাস রুমের দিকে হাঁটা ধরল। যদিও একবার দেখে গেছিল কিন্তু মিস চশমিশ কে চোখে পড়ে নি। এখন আবারো উঁকি মারল ক্লাসের দিকে। না সত্যি মিস চশমিশ আসে নি। রাগ সংযত করে হাঁটা ধরল ক্যাম্পাসের দিকে। বড় বট গাছের নিচে বসে আড্ডা মারছে সবাই। পাশ দিয়েই রিয়া, দিয়া আর তানিশা হেঁটে যাচ্ছে। খুব হাসাহাসি করছে। শান্ত একবার চোখ বুলিয়ে তাদের দিকে ফিরল। হাসিটা খুব জোড়দার। নিশ্চিত কাউকে আজ হেনস্তা করেছে। নাহলে তাদের হাসির স্বর এমন হতো না। দ্রুত হেঁটে পাশে এসে বসল আফিনের কাছে। রেগে ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে সে। দূরের বেঞ্চিতে বসা আহনাফ শান্ত’র আগমনে মুখ তুলে তাকাল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে শান্ত রেগে আছে। এটা নতুন কিছু না, শান্ত ছোট ছোট কারণেই অনেকটা রেগে যায়। তার রাগ অত্যাধিক। রাগে নীলাভ্রের কেনা কোক টা হাত থেকে কেড়ে নিয়ে নিজেই খেতে লাগল। নীলাভ্র অবাক চোখে তাকিয়ে আছে শান্ত’র দিকে। আহনাফ মুচকি হেসে বইয়ের পাতায় মুখ গুজল। এখন অবশ্য বই পড়ছে না সে। বইয়ের পাতায় একটা ছবি তে দৃষ্টি তার। হেসে দুল খাচ্ছে মেয়েটা। আহনাফ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেই হাসির দিকে। প্রাণবন্ত এই হাসির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে ওই মেয়েটার কথা মনে পড়ে যায় তার। সাহসী সেই মেয়েটা যে কি না শান্ত’র হাত থেকে ওই মেয়েটা কে বাঁচিয়েছিল। সত্যি বলতে মেয়েটার নাম এখন অবদি জানে না আহনাফ তবে তাকে যেন ভালো মতোই চিনে নিয়েছে সে। মুচকি হেসে বই বন্ধ করে ফেলে। মুহূর্তেই মনে পড়ে কেঁদে বের হয়ে যাবার কথা। কি হয়েছিল তখন?
এদিকে নীলাভ্র কোক টা কেড়ে নিয়ে দূরে সরে গিয়ে বলে,
“এটা আমার!
শান্ত ঠোঁট ভিজিয়ে বলে, আমি কখন বললাম এটা আমার!
নীলাভ্র নাক ফুলিয়ে চলে যায়। আহিম হেসে পাশে বসে শান্ত’র। তানিশা হেসে এক কোনে বসে দৃষ্টি রাখে আহনাফের দিকে। এই আহনাফ শুধু তার! ওর ভাগ কাউকে দেওয়া তো দূর চিন্তাও করতে পারে না সে। কিন্তু আহনাফ’র মনটা এখন অবদি পায় নি। আদৌও পাবে কি না তাও জানে না তবুও হার মানবে না। রিয়া হালকা ভাবে ধাক্কা দিয়ে বলে,
“এতো দেখিস না শেষে তো নজর লেগে যাবে।
তানিশা রিয়া’র ঘাড়ে হাত রেখে বলে,
“আমার নজর লাগলে সমস্যা নেই! কিন্তু সবার নজর থেকে বাঁচাতে হবে তাকে!
দিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, যদি সে তোর কথা ভাবতো তাহলেও তো হতো, সে তো ডুবে আছে অন্য কারোর জন্য !
“তোর কি সত্যি মনে হয় এই ৮ বছর পর সে ফিরে আসবে।
রিয়া হেসে বলে, যে ৮ টা বছর অপেক্ষা করতে পারবে সে সারাজীবন ও অপেক্ষা করতে পারবে!
মুহূর্তেই চুপ হয়ে যায় তানিশা। ঠোঁট ভিজিয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে আহনাফের দিকে। সত্যি কি তবে তাকে আর পাওয়া হবে না তার!
আহিম শান্ত’র কানের কাছে এসে ফুঁ দিতেই শান্ত লাফিয়ে উঠে। আহিমের দিকে একবার তাকিয়ে গাছের সাথে হেলান দেয় সে। আহিম ফিসফিসিয়ে বলে, মনে হচ্ছে আজ মিস বিড়াল চশমিশ কে শায়েস্তা করতে পারিস নি!
শান্ত শব্দ করে শ্বাস ফেলে বলল, সে আসলে তো!
“আসলে তো মানে, এই তো আমার সাথে দেখা হলো।
শান্ত চমকে উঠে বলে, কখন?
“অনেকক্ষণ আগে, তখন বোধহয় সবে ভার্সিটিতে আসল।
শান্ত চুপ হয়ে ভাবতে লাগল। একবার আহিমের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল। না আহিম তো তাকে আর মিথ্যে বলবে না আর সে নিজে বলেছিল চশমিশ কে আসতে। তাহলে এলো না কেন? নাকি এসে চলে গেছে। আমার থেকে পালানোর চেষ্টা!
মুহূর্তেই বাঁকা হাসল শান্ত। আহিম ভ্রু কুঁচকে নিল। শান্ত আহিমের কোলে মাথা রেখে বলল, খুব চালাক বুঝলি তো। আমার থেকে পালিয়ে পালিয়ে বাঁচছে!
“যা বিড়াল হাত ছাড়া হয়ে গেল!
“তাতে কি? আবার তো আসবে এখানেই তাই না!
বলেই মুচকি হাসল শান্ত। তার হাসি দেখে আহিমও হেসে ফেলল। আফিন তাদের পর্যবেক্ষণ করে ভাবতে লাগল কিছু একটা হতে চলেছে!
——
শুক্রবার পুরো দিনটাই ঘরে কাটাল আহনাফ। শান্ত অবশ্য একবার ফোন করেছিল তাকে কিন্তু আজ কোনভাবেই বাইরে বের হবে না সে। বিশেষ একটা দিন আজ। সারাদিন ঘরের মাঝে চুপ করে বসে ছিল আহনাফ। ইফা এসে কয়েকবার ডেকে গেছে খাবারের জন্য,নিচে যায় নি সে ! ঘরে দিয়ে যাওয়া খাবার টাও এখনো ল্যাম্পশেডের পাশে ঢেকে পড়ে আছে। আহনাফ পুরো ঘরটাই আজ শুধু বেলুন দিয়ে সাজিয়েছে। জন্মদিন আজ তার! কি করে ভুলতে পারে এই দিনটা সে! গতরাতে উইস করে একটা মেসেজ দিয়েছিল তাকে। মেসেজ সীন হয়েছে! শুধু ধন্যবাদ টুকু বলেই উধাও সে। সকাল হতে এই অবদি আর কথা হলো না। আহনাফের ইচ্ছে ছিল অনেক কিছু বলার বলা হলো।
অর্ডার করা কেক টাও এসে হাজির! সন্ধ্যা নেমে গেছে! এখন আর তাকে ফোন করেও পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতি বার’ই ফোন বন্ধ। তবে এটা নতুন কিছু না, সবসময় এমনটাই হয়। তবুও আজ একটু ব্যতীক্রম কিছুই প্রার্থনা করেছিল সে!
ঘড়ির কাঁটা ১০ টার দিকে ছুঁই ছুঁই! অন্ধকার ঘরে একা বসে আছে আহনাফ। সামনে থাকা কেক টা মোমবাতি এবার নিভে যাবে। সেটা বদলে আরেকটা মোমবাতি জ্বালালো সে। এই নিয়ে অনেক গুলোই মোমবাতি শেষ করলো সে। তবে মোমবাতি নিভতে দেয় নি। ফোনটা অনেকক্ষণ ধরেই বাজছে। শান্ত’র ফোন অবশ্য, মেসেজও জমে আছে অনেকটা। কোন কিছুতেই আগ্রহ নেই তার। ফোনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কখন সে প্রিয় মানুষটির নাম ভেসে উঠে স্ত্রিনে এই আশায়।
শান্ত এবার কল করল ইফা কে। হাতের সিগারেট টা শেষবারের মতো টান দিয়ে ফেলে দিল। সিগারেট খাওয়া অভ্যাস না তবে টেনশন হলে শুধু তখন খায়! সেটাও খুব কম কারণ শান্ত টেনশন নেবার মতো মানুষ না। সব বন্ধু মিলে আজ ক্লাবে যাবার কথা ছিল আহনাফ যায় নি বলে শান্ত ও যায় নি। ইফা’র কাছে জানতে পারল ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে আছে। দ্রুত আজকের তারিখ দেখল শান্ত। তবুও মন মানল না। ঘরে ছুটে এসে ক্যালেন্ডার দেখল। হ্যাঁ আজকের তারিখটায় লাল দাগ দেওয়া। ছোট করে লেখা হ্যাপি বার্থডে! কাজটা আহনাফ’র ! দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্ত মেঝেতে বসল। তার ধারণা রাত্রির ১২ টা বাজলেই আহনাফ এসে হাজির হবে তার ঘরে। দুটো বেড রুম আর একটা ড্রয়িংরুম নিয়ে শান্ত’র ঘর। দুটো বেড রুমেই বেলকনি আছে। তবে একটা ঘরে বেড নেই, সেই ঘরে শান্ত’র কিছু জিনিসপত্র রেখে দেওয়া। সেটা খুব’ই ব্যক্তিগত! কারো অনুমতি নেই সেই ঘরে ঢোকার। সবসময় বদ্ধ থাকে ঘরটা। আহনাফ অবশ্য ঢুকতে পারে। ড্রয়িংরুমটা অবশ্য অনেক বড়। এক পাশে সোফা সাজানোর পরও সামনে অনেকটা জায়গা খালি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এক রুমে বেড থাকার কারণে আহনাফ আসলে তার ঘুমোতে যেতে হবে ড্রয়িংরুমের সোফায়। যেখানে বিন্দুমাত্র তার ঘুম হয় না। কিন্তু কিছু করার নেই তার। ঘর থেকে বের হয়ে এবার নিচে নামতে যাচ্ছে শান্ত। তাদের এখানকার সোসায়টি হচ্ছে আবাসিক। দাড়োয়ান কে বলে আসতে হবে আহনাফ’র কথা। তার মন বলছে আহনাফ নির্ঘাত এসে উপস্থিত হবে!
অপেক্ষার অবসান ঘটল ১১.৩০ এ! আহনাফ আর বসে রইল না। তার দেখা এখন আর পাবে না এটা ধরেই নিয়েছে আহনাফ। বদ্ধ ঘরে শেষবারের মতো মোমবাতি জ্বালালো সে। ফোনটা ঘরে রেখেই হাতে কয়েকটা বিয়ার আর গাড়ির চাবি নিয়ে বের হয়ে গেল বাড়ি থেকে। বিয়ার খেতে খেতে গাড়ি ড্রাইভ করছে আহনাফ। রাগে তার দুচোখ লাল হয়ে আছে। ঠিকমতো ড্রাইভও করতে পারছে না তবুও এভাবেই এসে হাজির হলো শান্ত’র বাসায়!
আহনাফ’র হুশ এই আছে তো এই নেই। শান্ত তাকে কাঁধে উঠিয়ে নিয়ে আসছে। আহনাফ কোনভাবেই হাঁটার মতো অবস্থায় নেই! লিফট এসে থামল তার ফ্লোরে। আহনাফ মনে হচ্ছে অনেকটা ভারী হয়ে গেছে। ঠিকমতো তাকে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। তবুও হেলতে দুলতে নিয়ে ঘরে পৌঁছাল। আহনাফ’র মুখে একটাই কথা, ও আমার ফোন ধরে নি। কেন ধরেনি বল না শান্ত! কেন?
শান্ত তাকে ধপাস করে বেড’এ এসে ফেলে দেয়। অতঃপর কোমরে হাত রেখে বলে উঠে , তোকে ভুলে নতুন কাউকে পেয়েছে তাই!
বিছানায় শুয়ে থাকা আহনাফ মুহুর্তেই দাঁড়িয়ে গেল। শান্ত মনে মনে বলছে, পাগলামি এই শুরু হলো বলে! ঠিক তাই হলো। এতোক্ষণ যে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল সে এখন ঠিক সোজা হয়ে দাঁড়াল শান্ত’র সামনে। দুই বাহু শক্ত করে ধরে বলল, কি বললি তুই!
“বলছি এত রাতে আমার বাসায় কি করিস তুই!
“না না এটা বলিস নি তুই! তুই অন্য কিছু বলেছিলি।
“আচ্ছা! তাহলে কি বলেছিলাম বল তো!
আহনাফ খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। অতঃপর বলে উঠল, ভুলে গেছি!
“ভালো করেছিস! এখন চুপচাপ ঘুমোতে যা!
আহনাফ শান্ত কে হুট করেই জড়িয়ে ধরে বলে, তোর সাথে ঘুমাবো আমি।
“এই ছাড় আমায়, ছাড়। তোর সাথে আমি ঘুমাবো না।
“না আমি তোর সাথেই ঘুমাবো।
“না না আহনাফ একদম না!
বলতে বলতে তাকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়ল আহনাফ। শান্ত কোনমতেই ছাড়াতে পারছে না নিজেকে। আহনাফ বেশ শক্ত করেই ধরে আছে তাকে। শান্ত আজ নিজেও খুব ক্লান্ত ছিল। সারাদিন ধরে ঘর পরিষ্কার করেছে সে। কোমরে ব্যাথা ছিল, তার মধ্যে এই কথা আহনাফ কে আনতে গিয়ে ব্যাথা আরো বেড়েছে। এই নরম বিছানায় শুতেই কখন যে সে ঘুমিয়ে পড়ল টের পেল না। আহনাফ এভাবে শান্ত কে জড়িয়ে ধরেই ঘুমিয়ে গেল!
ঘন্টা খানিক পর হুশ ফিরল আহনাফ’র! মাথা ধরে আছে তার! মাথা ঝাঁকিয়ে দেখল শান্ত তার সামনে। ঘটনা মনে করতে লাগল। অতঃপর মনে পড়তেই হেসে শান্ত কে ধপাস করে ফেলে দিল বিছানা থেকে। শান্ত লাফিয়ে উঠল! নিজেকে মেঝেতে দেখতে পেয়ে আসন পেতে বসে বলল,
*আআআ! কি করছিস?
“আমার সাথে বিছানায় কি করছিস তুই, মেঝেতে ঘুমা!
“এটা আমার বেড রুম!
“আমি মেহমান! মেহমানদের কিভাবে খাতির করতে হয় জানিস না!
বলেই বালিশ ছুড়ে মারল। শান্ত’র ইচ্ছে করছে পাল্টা মার দিতে কিন্তু অনেক ঘুম পেয়েছে। তাই আর ঘুম নষ্ট করে না মেঝেতে বালিশ পেতে শুয়ে পড়ল। খানিকক্ষণ বাদেই ফোন বাজতে লাগলো। শান্ত’র এতে তেমন কোন সমস্যা হচ্ছিল না। তাই আহনাফ বেডের কাছে এসে পা দিয়ে শান্ত’র পিঠে গুঁতো দিয়ে বলল,
“এই উঠ!
“কি হয়েছে তোর আবার!
“ফোন বাজছে!
*বাজুক!
“আহ ঘুমাতে পারছি না ধরে দেখ না কে?
“এই মাঝরাতে এখানে এসে তোকে জ্বালাতে কে বলে বল তো!
বলেই মুচরোমুচরি করে ফোন তুলল শান্ত। ওপাশ থেকে ইফা’র গলার স্বর ভেসে এলো!
“শান্ত ভাইয়া, আহনাফ ভাইয়া নিজের ঘরে নেই। এই মাত্র ঘর থেকে বের হয়ে গেছে। পুরো বাড়িতে খুঁজেছি আমি কোথায় নেই!
শান্ত এক দমে বলল, আহনাফ আমার সাথে। এখানেই ঘুমাবে। টাঠা!
বলেই ফোন কেটে দিল। ইফা দ্বিতীয় বার কিছু বলার সুযোগ পেলো না। এদিকে ফোন রেখেই গুটিসুটি মেরে মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়ল শান্ত। আহনাফ কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থেকে পা দিয়ে আবারো জ্বালাতন শুরু করল শান্ত কে!
শান্ত ঘুম ঘুম চোখে বলে উঠল,
“কি?
“উপরে চলে আয়, মেঝে খুব ঠান্ডা।
“সমস্যা নেই , আমি ঘুমাতে পারব।
“আহ আয় না। পড়ে জ্বর আসবে তখন দেখার কেউ থাকবে না। আমার নিজের কাছেও অসুস্থ অসুস্থ মনে হচ্ছে!
শান্ত জবাব দিল না কিন্তু আহনাফ রীতিমতো পা নাড়িয়ে তাকে জ্বালাতন করতে লাগলো। শান্ত শেষমেষ খুব কষ্টে বিছানায় চলে এলো। আহনাফ তাকে দেখে হাসতে লাগলো। বিছানার এক কোনে গুটিসুটি মেরে শুয়ে রইল সে। আহনাফ হেসে তার গায়ে চাদর টেনে দিয়ে এপাশ হয়ে শুয়ে পড়ল। অতঃপর পকেট থেকে ওয়ালমেট বের করে তার ছবিটা দেখতে লাগল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেই ছবি ল্যাম্পশেডের কাছে রেখেই ঘুমিয়ে পড়ল সে। কখন যে চোখ থেকে এক অশ্রু গড়িয়ে পড়ল সেই খবর টের পেলো না আহনাফ!
ভোর হতেই আগে ঘুম থেকে উঠল আহনাফ! উঠে বসল সে। শান্ত’র দিকে তাকিয়ে দেখল এখনো গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। আহনাফ হেসে তার মাথায় হাত রাখল। শান্ত কে বিড়বিড় করতে দেখে কান পেতে শুনতে লাগল। কি বলছিল স্পষ্ট শুনতে পায় নি তবে একটা নাম এলো তার কানে। আহনাফ অবাক স্বরে বলল, চশমিশ!
অতঃপর মুচকি হেসে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল সে। ফ্রেস হয়ে রান্না ঘরে এসে সকালের নাস্তা বানাতে লাগলো। এলার্ম বাজতেই শান্ত উঠে পড়ল। আজ তার ঘুম পুরোপুরি হয় নি। সব দোষ আহনাফের। এই শয়তানের জন্য তার ঘুম হয় নি। চেঁচিয়ে নিজের চুল টেনে আবারো চাদরের মধ্যে লুকিয়ে পড়ল। ঘুমোতে যাবে ওমনিই আহনাফ এসে চাদর এক টানে গা থেকে সরিয়ে বলল, এই উঠ!
“যা তো এখান থেকে তুই! আমি ঘুমাবো।
“সারারাত কোথায় চুরি করতে গেছিল
“তোর জ্বালায় শান্তিতে ঘুমাতে পেরেছিলাম আমি! আহহ ঘুমাবো আমি।
আহনাফ হেসে চাদর মেঝেতে ফেলে দিয়ে বলল, ব্রেকফাস্ট বানানো শেষ, ওয়েট করছি আমি। জলদি আয়..
বলেই চলে গেল। শান্ত কয়েক সেকেন্ড পর উঠে বসল। বিরক্তি লাগছে তার কাছে। হেলতে দুলতে গিয়ে ফ্রেস হয়ে এসে বসল টেবিলে। আহনাফ তার দিকে নাস্তা এগিয়ে দিল। শান্ত ব্রেড সবে মুখে দিতেই আহনাফ বলে উঠে,
“এই চশমিশ টা কে শান্ত!
মুহূর্তেই চোখের ঘুম উধাও হয়ে গেল। হঠাৎ এমন কেন হলো বুঝতে পারল না। তবে কি আহনাফ কে মিস চশমিশ’র ব্যাপারে কিছুই বলে নি সে!
আহনাফ খেতে খেতে বলল, ঘুমের মধ্যে তার নাম নিচ্ছিল বার বার!
“তাই নাকি?
“হুম কে সে?
“কেউ না।
“তাহলে তার নাম নিচ্ছিলি কেন?
*তোর কি সত্যি মনে হয় চশমিশ কারো নাম হয়!
আহনাফ খাবার খাওয়ার মনোযোগ দিল। কথা বাড়াল না আর!
——
ইফা আর তিথি কোনভাবে’ই নিঝুমের সাথে যোগাযোগ করতে পারে নি। আজ সে ভার্সিটিতে আসবে কি না এটা নিয়েও তারা অস্থির। নিঝুম কে এতোবার ফোন করা সত্বেও ফোন তুলেনি সে!
গুটি গুটি পায়ে ভার্সিটির সামনে এসে দাঁড়াল নিঝুম। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে পা বাড়াল সে। কাঁধের ব্যাগটা ধরল শক্ত করে। সবাই তার দিকেই তাকিয়ে আছে। সবার ফিসফিস শব্দ তার কানে আসতেই অস্থির হয়ে উঠে নিঝুম। কানে হাত রেখে দ্রুত যেতে নিতেই থেমে গেল সে। কেউ দাঁড়িয়ে তার সামনে। মুখ তুলে তার সামনে তাকাতেই তার বুক ধক করে উঠল। কান থেকে হাত সরিয়ে চোঁখের পাতা ফেলে ফেলে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার দিকে। আহনাফ নিঝুমের দিকে দৃষ্টি রেখে বলল,
“তুমি!
নিঝুমের ঘোর ভাঙল। আহনাফ কে এড়িয়ে তার পাশ বেয়ে চলে গেল। এটার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে। কোন মেয়ে তাকে এভাবে এড়িয়ে যেতে পারে এটা ভাবতেই পারে নি আহনাফ। নিঝুম কে জিজ্ঞেস করার ছিল সেদিনের ব্যাপারে কিন্তু জিজ্ঞেস করতে পারল না। তার আগেই হন হন করে চলে গেল সে। আহনাফ অবাক দৃষ্টিতে নিঝুমের দিকেই তাকিয়ে রইল।
তানিশার পাশ দিয়েই চলে গেল নিঝুম। একবার অবশ্য দুজনের চোখাচোখি হলো। নিঝুমের চোখে তানিশা’র জন্য ঘৃণা ছিল। হয়তো সেটা তানিশা দেখে নি। তবে সে হাসল কারণ তার কাজ হাসিল হয়েছে। নিঝুম আহনাফ কে এড়িয়ে চলছে। কিন্তু কতোদিন, শুধু কি আজকের জন্য’ই ! না তা কেন? এটাই বরাবরের জন্য করতে হবে। নিঝুমের উপর নজর রাখতে হবে তার!
কিছুদূর আগাতেই আবারো থেমে গেল নিঝুম। থামে নি তাকে থামানো হয়েছে। আহনাফ কে এভাবে এড়িয়ে আসতে গিয়ে খুব খারাপ লাগছিল তার। এর মাঝেই হুট করে কতো গুলো মেয়ে থামিয়ে দিল তাকে। নিঝুম ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল তাদের দিকে। অতঃপর…
#চলবে….
[