এক শহর ভালোবাসা পর্ব ২৫+২৬

#এক_শহর_ভালোবাসা
#পর্ব_২৫
#সুরাইয়া_নাজিফা

সকালবেলা থেকে রান্না করতে ব্যাস্ত আমি।আজকে পুষ্পরা আসবে।অনেক খুশি লাগছে কতদিন পর পুষ্পকে দেখব।সাথে আমার বাবা মা ও আসবে। ছোট একটা গেট টুগেদারের আয়োজন করা হয়েছে। আমার সাথে রহিমা আন্টিও একটু সাহায্য করে দিচ্ছে। নিজেকে দেখে নিজেই অবাক হই তিনমাস আগেও যেই আমি রান্নার” র” ও জানতাম না। আর সেখানে আজ সব রান্নাই জানি। আসলেই মেয়েদের জীবনটাই অদ্ভুত। তবে শান যদি এখনও রান্না করতে দেখে খুব বকে আমাকে। কিন্তু আমি শুনলে তো।কারণ আমি জানি শান মুখে আমাকে বারণ করলেও সে আমার রান্না খেতে খুব পছন্দ করে। আর রীতিমত আমি রান্নাটাও এই জন্যই করি। আমারও ভালো লাগে শানকে রান্না করে খাওয়াতে।

এখন রান্না করছি মোরগ পোলাও। শান অনেক পছন্দ করে।আমি সব উপকরণ দিয়ে কসিয়ে রাখলাম। তারপর মাংসটা তুলে রেখে আগে থেকে আধ সেদ্ধ থাকা চালটা দিয়ে নাড়তে লাগলাম তখনই শ্বাশুড়ী মা এসে আমার পাশে দাঁড়ালেন। মাকে দেখে আমি বললাম,

“কি ব্যাপার মা তুমি এখানে কেন তোমাকে না বললাম রেস্ট নিতে আবার রান্নাঘরে এলে কেন?”
“আরে আমি ঠিক আছি এখন এতো চিন্তা করিস না। তুই তো আমাকে পার্মানেন্টলি ছুটিই দিয়ে দিয়েছিস এখন সারাদিন বসে কি করব । ”
আমি হেসে বললাম,
“হুম এখন রেস্ট করো সারাজীবন তো করেই এসেছো এখন আমি আছি না আমি সামলে নেবো। ”
আমার কথা শুনে মাও হাসল। আমি আবার রান্নায় মন দিলাম।

কিছুক্ষন পর মা বললো,
“জানিস তো সোহা তোকে যখন আমরা দেখেছি তখন তুই অনেক ছোট ছিলি। এই ক্লাস এইট-নাইনে পড়তিস হয়তো। এতো দর্শী মেয়ে ছিলি তোর মা সবসময় বলতো তোকে কে বিয়ে করবে? কিভাবে সংসার সামলাবি? সেই চিন্তায় তোর মা চিন্তিত থাকত। কিন্তু আজ তোকে দেখে আমি আগের সোহা আর এখনের সোহাকে মিলাতেই পারছি না। কি সুন্দর একদম পাক্কা গৃহিনী হয়ে গেছিস। একদম নিজের হাতে নিজের সংসারটা গুছিয়ে নিয়েছিস। এটা দেখে আমি খুব খুশি হয়েছি। সময়ের সাথে সাথে তোর ম্যাচিউরিটিটাও বেড়েছে। আশা করি শানকে তুই সবসময় ভালো রাখবি। ”

আমি মাথা নিচু করে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালাম।কিন্তু কিছু বললাম না।
শ্বাশুড়ী মা আবার বললেন,
“কিরে কথা বলিস না কেন? ”
আমি উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
“হুম মা রাখবো খুশি। এইবার দেখো তো টেস্ট করে কেমন হয়েছে? ”
মা হেসে একটু খেয়ে বললো,
“তুই রেধেছিস ভালোই হবে। তা সব রান্না শেষ? ”
“হুম মা এইতো পোলাওটা হলেই অলমোস্ট কমপ্লিট। ”

তখনই রহিমা আন্টি এসে বললো,
“সোহা মা তোমারে শান বাবা ডাকে কফি লইয়া যাওয়ার লাইগা।”
আমি আরেকটা চুলায় কফি বানিয়ে মগে ঢেলে রহিমা আন্টির হাতে দিয়ে বললাম,
“আমার কাজ আছে এখন যেতে পারবো না তুমি গিয়ে দিয়ে দেও। ”
তখনই মা এগিয়ে এসে বললেন,
“তোকে নিয়ে যেতে বলেছে যখন তুই যা না। রান্নাটা আমি দেখছি। ”
“কিন্তু মা…..।”
“কোনো কিন্তু না যা এখন। ”

আমি কফিটা নিয়ে উপরে চলে এলাম।শান বসে বসে মোবাইল টিপছিল আমি গিয়ে ওনার সামনে কফিটা রাখতেই উনি মাথা তুলে তাকালেন।
আমি বললাম,
“আপনার কফি। ”
শান আমার দিকে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত একবার দেখে নিলেন ড্যাবড্যাব করে। উনার এমন তাকানো দেখে আমি একটু ইতস্তত করে বললাম,
“আরে এভাবে কি দেখছেন? ”
শান কোনো কথা না বলে হঠাৎ ফোনের ক্যামেরা অন করে আমার ছবি তুলে নিলেন। উনার ব্যবহারে আমি অবাক হলাম,
“আজব তো এই পাগলের বেশে আমার ছবি তুলছেন কেন?”
শান অবাক হয়ে বললো,
“পাগল?”
“তা নয়তো কি?”
শান নিজের ঠোঁট কামড়ে হালকা হেসে বললো,
“যে অবস্থা আছো সেটা দেখলে যেকোনো মানুষ হার্ট এট্যাক করবে। ”
আমি চোখ ছোট ছোট করে বললাম,
“মানে?”
“মানে একটা বাচ্চা মেয়েকে যখন কেউ একদম এমন গৃহিনী রূপে, চুল হাত খোপা করে, শাড়ি কোমড়ে গুজে সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাহলে সামনের মানুষটার কি হবে সেটা কি সে জানে তাই প্রমান রাখলাম যদি আমার কিছু হয় তাহলে সেই মেয়ের ঐ রূপটাই দায়ি। ”

শানের কথা শুনে আমি লজ্জা পেয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম। তাড়াতাড়ি করে চুলটা খুলে দিয়ে কোমড় থেকে আঁচলটাও ছেড়ে দিলাম।
“এটা কি হলো?”
“কি হবে আমার কারণে কারো ক্ষতি হোক সেটা চাই না তাই ছেড়ে দিলাম। ”
শানও মুচকি হাসল আমার কথা শুনে।
“আজকে আরশ আর তিমির এই বাড়িতে আসবে জানো তো?”
শানের কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম আর চেঁচিয়ে বললাম,
“এই বাড়িতে আসবে মানে?”
“আস্তে বলো সবাই শুনবে। দেখো আজকে যেহেতু সবাই একসাথে একই জায়গায় থাকবো তাই যা ডিসিশন হওয়ার সেটা একসাথে হয়ে গেলেই ভালো হবে। পরে যখন ওরা ফিরবে ওদের আলাদা আলাদা বাড়িতে যেতে হবে। সেটা না করে আজকেই ওদের এই নাটকটা শেষ করা প্রয়োজন। এমন সুযোগ আর পাওয়া যাবে না। ”
“কিন্তু আমাকে আগে বলেননি কেন? ”
“আগে কখন বলবো সকালেই ঠিক করলাম তুমি বিজি ছিলে তাই বলা হয়নি এখন বললাম তো। ”
আমি হুট করে সোফায় বসে পড়লাম পাশে থাকা জগ থেকে পানি ঢেলে ঢকঢক করে একগ্লাস পানি খেয়ে নিলাম। শান আমার পাশে বসে বললো,
“কি হয়েছে তোমার? ”
“খুব ভয় করছে জানি না কি হবে।যদি কেউ না মানে?”
শান আমাকে আশ্বস্থ করে বললো,
“যা হবে ভালোই হবে আমি আছি তো।”
আমি শানের দিকে তাকাতেই উনি হাত দিয়ে ইশারায় হাসতে বললেন। আর আমিও ভরষা পেয়ে একটা ছোট্ট হাসি উপহার দিলাম।


শানের সাথে কিছুক্ষন কথা বলে আবার রান্নাঘরে গেলাম। তারপর রান্না শেষ করে আমি গোসল করতে গেলাম। বেশ অনেক সময় নিয়ে শাওয়ার নিলাম। শাওয়ার শেষে বের হতেই কেউ এসে আমার কোমড়ে ঝাপটে ধরল। হঠাৎ এমন হওয়াতে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। আমি কিছুটা চিৎকার করেই বললাম,

“কে?”
তখনই কেউ খিলখিলিয়ে হেসে বললো,
“ইয়ে মিষ্টি ভয় পেয়েছে মিষ্টি ভয় পেয়েছে। ”
পুষ্প হাত তালি দিচ্ছে আর লাফাচ্ছে। পুষ্পকে দেখে আমার মুখে এতক্ষনের ভয়ের জায়গায় হাসির রেখা ফুঁটে উঠল। আমি নিচে হাটু গেড়ে বসে পুষ্পকে ধরে বললাম,
“বাহ খুব মজা তাই না মিষ্টিকে ভয় দেখিয়ে আমি কতো ভয় পেয়েছি তুমি জানো?”
পুষ্প আমার গলায় জড়িয়ে বললো,
“স্যরি মিষ্টি একটু মজা করেছিলাম। ”
আমি পুষ্পর গাল টেনে বললাম,
“কেনো সমস্যা নেই সোনা। তা তোমরা কখন এলে। ”
তখনই একটা মেয়েলি কন্ঠে বললো,
“এইতো কিছুক্ষন আগে। সবার সাথে দেখা করে চলে এলাম তোমার কাছে। ”
আমি ভূমিকা আপুকে দেখে মুচকি হাসলাম তারপর উনার কাছে গিয়ে কুশল বিনিময় করে বললাম,
” কতো মিস করেছি করেছি তোমাদের। ”
“মিস করলে একবারও যাওনি কেন ঢাকায়। পুষ্প তো সবসময় তোমার কথাই বলে।স্কুল বন্ধ দিতে না দিতেই আমাদের তো পাগলই করে দিয়েছে নিয়ে আসার জন্য। ”
“হুম আমারও পুষ্পর কথা সবসময় মনে পড়ত কিন্তু এখানে এই কয়েকমাসে এতো ঝামেলা গেছে যে যাওয়ার সময়ই পাইনি। তা থাকবে তো কিছুদিন?”
“হুম তা তো থাকবোই। ”

আমি আর ভূমিকা আপু অনেকক্ষন আড্ডা দিলাম। তারপর খাওয়ার জন্য ডাকতেই আমরা সবাই নিচে নেমে গেলাম। আমি সবাইকে খাবার সার্ভ করে দিলাম। ভূমিকা আপুরা জার্নি করে এসেছে তাই পুষ্পকে আমিই খাইয়ে দিচ্ছিলাম আর আপুকে খাওয়ার জন্য বসিয়ে দিলাম। সাম্য ভাইয়া খেতে খেতে বললো,
“ওয়াও রান্নাটা অনেক ভালো হয়েছে কে করেছে?”
মা বললো,
“আজকে সব রান্না সোহাই করেছে। ”
ভূমিকা আপু অবাক হয়ে বললো,
“বাবা সোহা এতদিন শুধু মায়ের মুখে তোমার প্রসংশাই শুনেছি এখন বুঝতে পারছি কেন এতো প্রসংশা। তুমি যখন এই বাড়িতে বিয়ে হয়ে এসেছিলে তখন কোনো রান্না জানতে না আমার বেশ মনে আছে। এই কয়েক মাসেই এতো পরিবর্তন। ”
আমি কিছু না বলে শুধু হাসলাম। শান মাথা নিচু করে খেয়েই যাচ্ছিল তখনই ভূমিকা আপু একটু কাশার অভিনয় করে বললো,
“তা শান বউয়ের রান্না পছন্দ হচ্ছে তো?”
শান খেতে খেতে বললো,
“কেউ ভালো রান্না করলে পছন্দ হতেই পারে। ”
“হুম দেখতেই পাচ্ছি এজন্যই তো কোনো কথা না বলে খেয়েই যাচ্ছো।এমন বউ হলে পছন্দ না হয়ে কোনো উপায় আছে। ”

ভূমিকা আপুর কথা শুনে সবাই খিলখিলিয়ে হেসে উঠল আর আমি লজ্জায় মাথা নিচে নামিয়ে নিলাম।আর শান দ্রুত খাবার টেবিল থেকে উঠে গেল বাঁচার জন্য।


বিকাল আর দুপুরের মাঝামাঝি সময়টাতে আমি,ভূমিকা আপু আর পুষ্প এসে পুল সাইডে বসলাম। আমাদের বিপরীতে শান আর আরশ ভাইয়া হয়তো বিজন্যাস সম্পর্কিত কথা বলছে। তাতে আমার কোনো আগ্রহ নেই। ভূমিকা আপুও অনেক কথা বলছে আমি শুধু হেসে হেসে তার কথার শায় দিচ্ছি ঠিকই কিন্তু আমার এক কানে কথা ঢুকছে অন্য কান দিয়ে কথা বেরিয়ে যাচ্ছে।আমি নখ কামড়াচ্ছিলাম আর আপুর কথা ভাবছিলাম। আমার তো প্রচুর টেনশন হচ্ছিল। আজকে যখন আরশ ভাইয়া আর স্মৃতি আপুকে সবাই একসাথে দেখবে তখন যে কি হবে ভাবতেই আমার শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ার উপক্রম।

তখনই ভূমিকা আপু বললো,
“এই সোহা কি হয়েছে? আমার কথা শুনেছো তুমি। ”
ভূমিকা আপুর কথা শুনে আমি ঘোর থেকে বেরিয়ে সোজা হয়ে বসে বললাম,
“হুম হ্যাঁ শুনেছি তো। ”
ভূমিকা আপু বললেন,
“তারপর কি হয়েছে জানো পুষ্প তো ডিলই মেরে দিয়েছে ওই ছেলেটার কপালে। ”

শুনেই এতো টেনশনের মধ্য আমার হাসি এসে গেল। আর ভূমিকা আপুও হো হো করে হেসে উঠল। আসলে ভূমিকা আপু আমাকে পুষ্পর দর্শীপনার কথা বলছিলো। স্কুকে কোন ছেলের সাথে ঝগড়া করে মাথা ফাঁটিয়ে দিয়েছে।

“আচ্ছা আপু কমলাকে কি ঢাকায় রেখে আসছো? ”
“হ্যা তবে আমরা এখানে আসাতে ও ওর গ্রামের বাড়ি চলে গেছে। নাহলে ওকেও নিয়ে আসতাম। ”
“ওহ। ”

এসব নিয়ে কথা বলতে বলতে তখনই পুষ্প দৌঁড়ে এসে বললো,

“মিষ্টি চলো আমরা খেলবো। ”
আমি ইনিয়ে বিনিয়ে বললাম,
“আমি এখন খেলবো না সোনা। আমার ভালো লাগছে না। তুমি একা খেলো না। ”
পুষ্প বায়না ধরে বললো,
“না না তোমাকে খেলতেই হবে আসো। ”

পুষ্প বেশী বায়না করছিলো আমি আর কি করবো কোনো উপায় না পেয়ে পুষ্পর সাথে খেলার জন্য উঠলাম। আমার মন একটু খারাপ ছিলো। শানের চোখ আমার চোখে পড়তেই শান ইশারায় বললো,
“কি হয়েছে? ”
আমি মাথা নাড়ালাম। কিন্তু উনি হয়তো বুঝতে পারলেন আমার চিন্তাটা কোথায় হচ্ছে তাই উনি আমাকে ইশারায় সাহস জোগানোর চেষ্টা করছিলেন। উনার আমার প্রতি এতো খেয়াল দেখে আমার মনটা খুশিতে নেচে উঠলো।

হঠাৎ শানের ফোনে কল আসতেই শান আমাদের থেকে একটু দূরে উঠে গিয়ে একবারে পুলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।আমি পুষ্পকে উদ্দশ্যে করে বললাম,

“কি খেলা খেলবে বলো?”
“দৌঁড়া দৌঁড়ি খেলা। ”
আমি চমকে উঠে বললাম,
“এটা আবার কেমন খেলা? ”
“আছে আমরা স্কুলে খেলি। আমি দৌঁড়াবো আর তুমি আমাকে ধরবে ঠিক আছে। ”
আমি হেসে বললাম,
“আচ্ছা। ”

তারপর খেলা শুরু হলো। পুষ্প দৌড়াতে লাগলো আর আমি ওকে ধরার চেষ্টা করছি ও বারবার পুলের কাছে চলে যাচ্ছিল আর শানের চারপাশে ঘুরছিলো। আমি এতক্ষনের চিন্তা ভুলে গিয়ে পুরো খেলার মধ্যে ঢুকে গিয়ে ছিলাম।আমি পুষ্পকে ধরার চেষ্টা করছিলাম। বাট পুষ্প বারবার শানের পিছন পিছন লুকিয়ে যাচ্ছিল। তখনই পুষ্পকে ধরার জন্য যেই না হাত বাড়াতে যাবো হুট করে আমার পা শাড়ীর সাথে বেজে স্লিপ করে আমি পরলাম শানের গায়ের উপর। পুষ্প পেছন থেকে সরে যেতেই শান তাল সামলাতে না পেরে আমাকে নিয়ে পড়ল পুলের মধ্যে। আর আমার ঠোঁটটা গিয়ে লাগলো শানের লাগে।

পুলের মধ্যে পরেই কিছুক্ষন নাকানি চুবানি খেয়ে শান ঠিকঠাক ভাবে দাঁড়িয়ে একহাত দিয়ে আমার কোমড় ধরে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে রাখল। আমি ফ্যালফ্যাল করে শানের দিকে তাকিয়ে থাকলাম আর কিছুক্ষন আগের কথা ভেবে লজ্জায় আমি তাকাতে পারছি না শানের দিকে।এই প্রথম আমি শানকে কিস করলাম। যদিও এক্সিডেন্টলি তবে করেছি তো। শান আমার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে রইল। তখনই খিলখিলিয়ে কিছু মানুষের হাসির আওয়াজ শুনতে পেলাম। আওয়াজ শুনে আমরা দুজনেই পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখলাম ভূমিকা আপি, পুষ্প আর ভাইয়া দাঁড়িয়ে হাসছে। আমি আর শান দুজন দুজনের থেকে একটু দূরে সরে আসলাম। কিছুক্ষন পর ভাইয়া ওখান থেকে সরে যেতেই ভূমিকা আপু বললো,

“হাউ রোমান্টিক সিন। বৃষ্টি না হোক তবে পুলের এই ঠান্ডা পানিতে ভিজে পুরে এই শীতের মধ্যে দাঁড়িয়ে চোখে চোখে প্রেম করা হচ্ছে। ”

আমি কাঁপা কন্ঠে বললাম,
“না তেমন কিছুই না। ওটা পুষ্পের জন্য….।”

আমি কথা শেষ করার আগেই ভূমিকা আপু বললো,
“থাক আর সাফাই দেওয়া লাগবে না এভার দুজনেই উঠে গিয়ে চেন্জ করে নেও নাহলে ঠান্ডায় মরে যাবে। ”

কথাটা বলেই ভূমিকা আপুও চলে গেল পুষ্পকে সাথে নিয়ে। এখন আমি আর শান আছি। শান আমার আগেই পুল থেকে উঠে গেল। কিন্তু এখন আমি শাড়ি পড়ে কেমনে উঠবো বুঝতেছি না। কারণ পুলের সিড়ি হচ্ছে অন্য সাইডে তাই আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম।

হঠাৎ শান বললো,
“কি ব্যাপার এই ঠান্ডার সময় ঠান্ডা পানিতে দাঁড়িয়ে থাকতে খুব মজা লাগছে বুঝি যে উঠতেই চাইছো না। ”
“উঠবো কেমনে শাড়ি পড়ে এভাবে উঠতে কষ্ট হচ্ছে। ”
“শাট আপ মেয়ে নিজেকেই সামলাতে পারো না আবার শাড়ীও পড়ো কি দরকার পড়ার। জলদি উঠে এসো। ”

উনি আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো।আমার একটু রাগ লাগছিলো। আমি মুখ ফুলালাম। তবে এখন আমাকে উঠতে হবে যে শীত লাগছে।তাই আমিও শানের হাতের উপর হাত রেখে রেখে পুল থেকে উঠে এলাম। শান আর আমি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শান রেগেই বললো,

“বাচ্চাদের সাথে পুরো বাচ্চা হয়ে যাও কি করো না করো কোনো হুশ থাকে না। এখন যদি জ্বর হয় তখন কি হবে? ”

আমি কোনো কথা না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম শান আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। ভিজে যাওয়ার কারণে আমার শরীরে শাড়িটা পুরো বসে গেল। শীতে আমার কাঁপাকাঁপি অবস্থা।ঠোঁটও হালকা নীল বর্ণ ধারণ করেছে শান আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
“দ্রুত রুমে চলে যাও সাবধান কেউ যেনো না দেখে। ”

শানের কথা শুনেই আমি বুঝতে পেরেছি উনি কেন এমন বলছিলেন। আমি শাড়িটা কোনোরকম গায়ে পেঁচিয়ে কোনোমতো দৌড়ে চলে গেলাম। রুমে গিয়েই শাড়ি একটা নিয়ে ওয়াস রুমপ চলে গেলাম। ফ্রেস হয়ে এসে শীতে কাঁপতে লাগলাম। সুয়েটার, চাদর যা ছিল সব বের করে পড়ে নিলাম। তখনই দেখলাম শান আসছে মাথা মুছতে মুছতে । শান হয়তো অন্য ওয়াশরুমে গেছিলো। আমি ঘুটি শুটি হয়ে বসে রইলাম তখনই শান আমার পাশে এসে বসলো। আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। উনার তাকিয়ে থাকা দেখে আমি বললাম,

“কি হয়েছে এভাবে কি দেখছেন? ”
শান গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“তোমার জন্য আজ আমার কত লস হয়েছে জানো তুমি। আমার ফোনটা গেল সাথে আমার একটা ইমপরটেন্ট ক্লাইন্টের সাথে কথা হচ্ছিল সেটাও গেল এখন এই ক্ষতিপূরণ গুলো কে দিবে?”
আমি মুখ গোমড়া করে বললাম,
“স্যরি আসলে খেয়াল করিনি। ”
“খেয়াল করিনি বললেই হলো নাকি ক্ষতি পূরণ চাই আমার। ”
আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম,
“কি দিবো আমি আমার কাছে কিছু নেই। ”
“আছে তোমার কাছেই আছে যেটা আমার সব ক্ষতিপূরণ করতে পারবে। ”
“আমার কাছে কি?”

শান আমার কাছে এসে একটু মুচকি হেসে বললো,
“তখন পুলে পড়ার আগে যেভাবে কিস করে ছিলে সেভাবে কিস করতে হবে তবে এভার ঠোঁটে। ”

উনার কথা শুনে আমার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম আমি চিৎকার করে বললাম,
“ওটা এমনি হয়ে গেছে ইচ্ছা করে করিনি আমি পারবো না।”
শান রেগে বললো,
“পারবে না মানে আমি তো আমার ক্ষতিপূরণ না নিয়ে ছাড়ছি না। ”

বলেই শান আমার দিকে আগালো। আমি একটু সরে গিয়ে বললাম,
“দেখুন এতে আমার দোষ নেই আমি তো পুষ্পর জন্য পড়েছি। ”
“তুৃমি কার জন্য পড়েছো সেটা দেখে তো আমার কোনো লাভ নেই। আমি তোমার জন্য পড়েছি এটাই বড় কথা। এভার আমার ক্ষতিপূরণ দেও। ”

শান কথা বলতে বলতে আরেকটু আগালো আমার দিকে। আমি উপায় না পেয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বেরোতে যাবো ঠিক তখনই শান হাত ধরে টান দিয়ে উনার বুকের উপর নিয়ে ফেললো। আর আমার দিকে তাকিয়ে ধীর কন্ঠে বললো,
“তোমার কি মনে হয় আমি না চাইলে তুমি পালাতে পারবে। ”

উনার কন্ঠ শুনে আমার বুকের ভিতর ধুকধুক করতে লাগল। উনি আমার কোমড় ধরে আরো কিছুটা শক্ত করে ধরে উনার দিকে এগিয়ে নিলেন। আস্তে আস্তে উনি আমার দিকে এগিয়ে আসছিলেন। আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম। উনার গরম নিঃশ্বাস আমার মুখে পড়ছিলো তখনই পুষ্প দৌঁড়ে এসে বললো,

“মিষ্টি চলো তোমাদের নিচে ডাকছে। ”

হঠাৎ পুষ্পের কন্ঠ শুনেই আমি আর শান দুজন দুজনের থেকে ছিটকে দূরে সরে গেলাম। পুষ্পকে দেখে আমার মুখে হাসি ফুটে উঠল। শানের দিকে তাকিয়ে দেখলাম শান মুখ গোমড়া করে আছে।শানের অবস্থা দেখে আমার পেট ফেটে হাসি চলে আসল।

আমি পুষ্পকে বললাম,
“হ্যাঁ সোনা চলো আমাদের দেরী হচ্ছে। ”

আড়চোখে শানকে একবার দেখে পুষ্পর হাত ধরে বেরিয়ে গেলাম। ওরা বেরিয়ে যেতেই শান বিরবির করে বললো,

“উফ মেয়েটা আর আসার টাইম পেলো না ধ্যাত। ”


ড্রয়িংরুমে আমরা সবাই বসে আছি। কিছুক্ষন আগেই আমার বাবা মা ও এসেছে। আমি সবার সাথে কুশল বিনিময় করে সবার সাথে বসে আছি। সবাই হাসি মুখে গল্প করছিলো হঠাৎ করে দরজার দিকে চোখ যেতেই সবার চোখ আটকে গেল। সবাই বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। আমার বাবার হাতে একটা পানির গ্লাস ছিলো সেটাও ঠাস করে হাত থেকে পড়ে দুই ভাগে ভেঙে গেল। সবাই অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে আছে আরশ আর ম্মৃতির দিকে। আমি ভয়ে শক্ত করে শানের হাত চেপে ধরলাম। জানি না এরপর কি হবে?
.#এক_শহর_ভালোবাসা
#পর্ব_২৬
#সুরাইয়া_নাজিফা

স্মৃতি আপু আর আরশ ভাইয়া মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আর সবার রাগ আর কৌতুহলী দৃষ্টি তাদের দুজনের দিকেই তাক করে আছে। থাকবেবাই না কেন সেই যে বিয়ের দিন উদাও হয়ে গেল দুজনেই আর আজ তিনমাস পর একসাথে ফিরে এলো অবাক তো হওয়ারই বিষয়।

হঠাৎ শ্বাশুড়ী মা ওদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে উঠলেন,
“আরশ তুই? এতদিন কই ছিলি আর স্মৃতিকে কই পেলি?”

আমি বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিয়ে শানের গা ঘেঁসে দাঁড়ালাম। হয়তো এখনও কেউ বুঝতে পারেনি কিছু। তখনই আরশ বললো,
“আসলে মা আমি আর স্মৃতি….। ”

আরশ ভাইয়া কিছু বলার আগেই বাবা কাছে এসে বললো,
“ব্যাস আর কিছু বলার দরকার নেই।আর কি শুনবে তুমি মায়মুনা দেখে বুঝতে পারছ না এরা দুজন একসাথেই পালিয়ে ছিল। ”

শ্বাশুড়ী মা আঁতকে উঠে বললেন,
“মানে?
তিনি যেন এখনো বিশ্বাসই করতে পারছে না। বাবা মাকে বললো,
“হ্যাঁ মাইমুনা এটাই সত্যি নাহলে একই দিনে দুজনে একসাথে কোথা থেকে আসবে তুমিই বলো? ”
শানের বাবা ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো আরশ ভাইয়ার দিকে,
“তোমার লজ্জা করল না আরশ সেদিন সোহা নামের এই ফুলের মতো মেয়েটাকে বিয়ের আসরে ফেলে রেখে পালিয়ে গেলে।কারো কাছে মুখ দেখানোর যোগ্য রাখোনি আমার প্রাণের বন্ধুর কাছেও ছোট করেছো। তোমার যদি সোহাকে পছন্দ নাই হবে তাহলে বিয়ের আগে কেন বলোনি আমাদের। কেন এই নাটকটা করলে তোমরা দুজন মিলে? ”

আরশ আর স্মৃতি একে অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করছে যেন ওরা জানেই না এখানে কি হচ্ছে। হঠাৎ আপু চিৎকার করে বলে উঠল,
“এসব কি বলছেন আপনারা সবাই আমরা দুজনেই কেন পালাবো?”
আরশ ভাইয়াও বললো,
“হ্যাঁ বাবা আমরা পালাবো কেন?আমাদের মধ্যে থুরি না পালানোর মতো কোনো সম্পর্ক আছে। তোমরা কেন এভাবে হা হুতাশ করছো। ”
ওদের কথা শুনে শ্বশুর মশাই অবাক হয়ে বললো,
“তাহলে তোমরা দুজনেই একসাথে কোথায় গায়েব হয়ে গেছিলে সেদিন বিয়ের আসর থেকে ?আর এখনই বা কোথায় থেকে আসলে?”
আরশ হেসে বললো,
“আমি তো ট্যুরে গেছিলাম। তুমি তো জানো বাবা আমার ঘুরতে কতো ভালো লাগে তাই শান ভাইয়া টাকা দিতেই আমি ট্যুরে চলে গেলাম। ”

ওদের দুজনের কথা শুনে আমার মাথায় যেন আসমান ভেঙে পড়ল। মানে? কোন ট্যুরে গেছিলো? আর কি বলে এদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক ছিলো না মানে? আমার মাথা গোল গোল ঘুরতে লাগল। এদের কথা গুলো আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। কালকে পর্যন্ত যখন এদের সাথে কথা বলছিলাম এরা টেনশনে মরে যাচ্ছিল।কেউ মেনে না নিলে একে অপরকে ছেড়ে থাকতে পারবে না বলে। মরে যাবে বলছিলো। আর আজ এমন ভাবে কথা বলছে যেন দুজন দুজনকে চিনেই না। না আমার ছোট্ট মাথাটা আর এই চাপ নিতে পারতেছে না। আমি শানের দিকে তাকিয়ে ইশারায় বললাম,

“এসব কি হচ্ছে?”
শান আমার কথা শুনে শুধু হাসছিলো কিন্তু কোনো কথা বললো না।তবে ইশারায় বললো সামনে তাকাতে। আমি পুরা বেকুবের মতো একবার সামনে তাকাচ্ছি একবার শানের দিকে।এরা সবাই মিলে কি কারসাজি করছে সেটাই তো মাথায় আসছে না। তখনই ভূমিকা আপুর কথা শুনে আমি ওদের কথায় মনোযোগ দিলাম।

ভূমিকা আপু কিছুটা টোন কেটেই বললো,
“তা স্মৃতি তুমিও বুঝি ট্যুরেই গিয়েছিলে? ”
ভূমিকা আপু কথা শুনে স্মৃতি আপু থতমত খেয়ে খানিকটা তুতলিয়ে বললো,
” ঐ ম মানে হ হ্যাঁ। আমিও ট্যুরেই গিয়েছিলাম তবে ভার্সিটির ফ্রেন্ডদের সাথে? ”
ভূমিকা আপু একহাতে নিজের নাকটা খানিক চুলকে হেসে বললো,
“আর তোমাকেও টাকাটা নিশ্চয়ই শানই দিয়েছে? ”
স্মৃতি আপু জোরে জোরে মাথা ঝাকিয়ে বললো,
“শান ভাইয়া। ”

ওদের কথা শুনে এইবার সবার টনক নড়ল। আর আমার মাথার স্ক্রু নড়ে উঠল। আপাতত আমার দেখা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। তাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দর্শকের ভূমিকা পালন করছিলাম। এতক্ষন আমার বাবা চুপ থাকলেও এইবার উনি এগিয়ে এসে বললেন,

“তোমরা কি আমাদের সাথে মজা করছো?বিয়ের দিন রাতে তোমরা দুজনেই পালিয়ে গেলে আর এখন এসে বলছো শান তোমাদের টাকা দিলো যাতে ঘুরতে যেতে পারো। তোমরা কি ভেবেছো একটা কথা বললেই আমরা বিশ্বাস করে নেবো।শান তোমাদের মতো কাণ্ডজ্ঞানহীন নয় যে বিয়ের আসর থেকে তোমাদের দুজনকে ঘুরতে পাঠাবে।তোমরা কি ছোট নাকি কি করে এমন একটা জঘন্য কাজ করতে পারো। ”

আপু একটু ভয় পেয়ে গেল। আপুকে সামলাতে আরশ ভাইয়া আমার বাবার কাছে এসে বললো ,
“আরে আঙ্কেল গল্পের মেইন টুইস্টই তো আপনারা জানেন না কেউ। এখানো তো আসল ঘটনা বলা বাকি আছে।”

বাড়ির সবাই একসাথে বলে উঠল,
“আসল ঘটনা মানে? ”

আরশ ভাইয়া একটা দীর্ঘচ্বাস ফেলে বললো,
“শুনুন তাহলে সেই দুঃখের ঘটনা। আমার বিয়ে ঠিক হলো আমি তো অনেক খুশি হলাম এট লিস্ট এই ছাব্বিশ বছরে এসে আমার বিয়ের ফুল ফুটল। বিয়ের জন্য সব প্লান প্রোগ্রাম করে ফেললাম, বন্ধুদের বলা হয়ে গেল, নিজে পছন্দ করে শেরওয়ানি কিনলাম, নিজের বিয়েতে নিজেই নাচানাচি করলাম খুশিতে। কিন্তু কে জানতো আমার সেই খুশি বেশীক্ষন টিকবে না।”
সবাই গোল গোল অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,
“টিকবে না কেন?”
আরশ ভাইয়া কান্নার ভঙ্গিতে বললো,
“সেটাই তো দুঃখের কথা বিয়ের দিন সকালে শান ভাইয়া আমার রুমে আসল। ভাইয়াকে দেখে আমি একটু অবাক হলাম যে সকাল সকাল আমার রুমে কি? ভাইয়ার কি বিয়ের খুশিতে ঘুম আসছে না। ”

তখনই ভাইয়া এসেই বললো,
“আরশ প্লিজ তুই এই বিয়েটা করিস না। ”
ভাইয়ার কথা শুনে আমার খুশিতে একজগ ঠান্ডা ঠান্ডা পানি পড়ে গেল এই শীতের দিনে। আমি মুখ গোমড়া করে বললাম,
“কেন?”
ভাইয়া বললো,
“দেখ আরশ আমি সোহাকে অনেক ভালোবাসি। সোহাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। তাই আমি চাই না তুই সোহাকে বিয়ে করিস। তাই তুই বিয়ের দিন রাতে পালিয়ে যা। ”
“কিন্তু আমি যাবো কোথায়?আর সবাই কি বলবে?”
ভাইয়া আমার হাতে ক্রেডিট কার্ডটা দিয়ে বললো,
“যেখানে খুশি সেখানে যা এটা নিয়ে আর বাকি সব আমি সামলে নেবো। ”

তারপর আর কি আমিও চলে গেলাম ওইদিনই ট্যুরে। ”

এইবার আমার শ্বশুরমশাই বললো,
“আর স্মৃতি কেন পালালো?”
স্মৃতি আপু মন খারাপ করে বললো,
“কেন আবার সোহা বিয়ের দিন এসে বললো প্লিজ আপু তুমি বিয়েটা ভেঙে দেও।শানকে বিয়ে করো না। ”
আমি বললাম,
“কেনো?”
সোহা কান্না করে বললো,
” আমি শানকে ভালোবাসি কিন্তু বাবার ভয়ে এটা বলতে পারছি না এখন যদি আরশ ভাইয়ার সাথে আমার বিয়ে হয় আমি কিন্তু সুইসাইড করব বলে দিলাম। ”

ব্যাস ছোট বোনের মুখে এমন কথা শুনলে আর ভালো থাকা যায়,আর ছোট বোন যাকে ভালোবাসত তাকেই বা আমি কি করে বিয়ে করতাম লজ্জা বলতে তো একটা কথা আছে। এখন যদি আমি বিয়ে ভাঙ্গতে চাইতামও বাবা কখনো সেটা হতে দিতো না। তাই আমিও চলে গেলাম আর আমার সব খরচের টাকা শান ভাইয়া দিলো এটাই।

এটাই শোনার বাকি ছিল। এই কথা আমি কখন বলছিলাম।আমি শানের কনুইয়ে জোরে একটা চিমটি কেটে বললাম,
“ওরা এসব কি বলছে মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি?আমি স্মৃতি আপুকে এসব কথা কখন বললাম আর ওরা ট্যুরেই বা কবে গেল? ”

শান হাত ঢলতে ঢলতে বললো,
“উফ কি করছো তুমি চামড়া তুলে ফেলবে তো।”
আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
“বেশ করবো? আগে কারণ বলুন আমাকে?”
শান আমার কানে ফিসফিস করে বললো,
“জাস্ট সি সুইটহার্ট। এখনো অনেক কিছু দেখার বাকি আছে। ”

কথাটা বলেই উনি আবার সামনে তাকালেন। আর এতক্ষনে যে টেনশন স্মৃতি আপু জন্য হচ্ছিল সেটা এখন নিজের জন্য হচ্ছে না জানি বাবা মা আমাকে কি বলে। আমি নিজের নখ খুটতে লাগলাম।

তখনই দুই বাবা আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। আমি মাথা নিচু করে দাঁড়ালাম তারা গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে। আমার বুক কাঁপছে তখনই তারা দুজনেই খিলখিলিয়ে হেসে দিলো। এভাবে হাসির শব্দ শুনে আমি দ্রুত মাথা তুলে তাকালাম। বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

“বাবাকে এতো ভয় পাস কেন মা? আমরা কি তোর পর। তুই যদি আমাকে আগেই বিষয়টা বলতি আমি সামলে নিতাম এত কিছু করার কারণই ছিল না। ”

আমি মিনমিনিয়ে বললাম,
“স্যরি বাবা। ”
তখনই আমার শ্বশুরমশাই বললো,
“আরে স্যরি বলার কিছু নাই আমরা কিছু মনে করিনি। হ্যাঁ আমরা রাগ করতাম যদি এটা তোদের বিয়ের আগে জানতে পারতাম আমাদের ডিসিশনের বিরুদ্ধে যাওয়ার জন্য। কিন্তু বিয়ের পর আমরা বুঝেছি সেদিন যদি বিয়েটা হতো তাহলে তোরা কখনোই সুখি হতি না কারণ শান আর সোহার জুটিই বেষ্ট জুটি সেটা আমরা এই কয়েকমাসে বুঝে গেছি। সোহার জন্য শানই পারফেক্ট যে তাকে সবসময় সুখে রাখবে। ”

আমি মাথানিচু করে খানিকটা হাসলাম। বাহ আমি যেই ঘটনাটা নিয়ে এতো ভয় পাচ্ছিলাম সেটা এতো ইজিলি মিটে যাবে বুঝতে পারিনি তো।


আজকে একসাথে সব খুশি ফিরে এসেছে। এই পরিবারের এতদিন যেই অপূর্ণতা ছিল সেটাও পূর্ণতা পেয়ে গেছে।নতুন বছরে সব কিছু এতো ভালো ভালো হবে সব যে নতুন করে ফিরে পাবো সেটা ভাবতেই পারিনি। সবার মুখে হাসি দেখা যাচ্ছে আমারও খুব ভালো লাগছে। শুধু একটা কথা জানার জন্য মনটা আকুপাকু করছে। কিন্তু এদের একজনকেও ভাগে পাচ্ছি না যে জিজ্ঞেস করব। কিন্তু জানতে না পারলেও শান্তি লাগছিলো না।

হঠাৎ দেখলাম শান উঠে চলে গেল রুমের দিকে। শানকে যেতে দেখে চুপিচুপি আমিও রুমে চলে এলাম। রুমের ভিতরে ডুকেই ধুম করে আমি দরজাটা আটকে দিলাম। আমি দরজাটা আটকাতেই শান চমকে উঠে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

“কি করছো এসব? এভাবে দরজাটা আটকালে মানুষ কি বলবে? সবাই নিচে আছে? ”
“কিছু বলবে না আগে আপনি বলুন এসব কি থেকে কি হচ্ছে। ”
শান কিছু না বলে একটা ভাব নিয়ে আবার নিজের ল্যাপটপে চোখ দিয়ে বললো,
“বলেছিলাম তো হেল্প করব করেছি আর কি চাও। ”
আমি উনার সামনে বসে উনার ল্যাপটপটা বন্ধ করে দিয়ে বললাম,
“জানতে চাই মেইন কথা। আপনি সকালে তো এই বিষয়টা আমাকে বলেনি।”
শান ভ্রু কুচকে বললো,
“ল্যাপটপটা বন্ধ করলে কেন?”
“আগে আপনি বলুন। ”

শান নিজের পায়ে পা তুলে বললো,
“অনেক প্লান প্রোগ্রাম করে এই প্লানটা করতে হয়েছে আর তোমাকে বলিনি একটা সারপ্রাইজ দিবো বলে।”
“সারপ্রাইজ? ”
“হুম। দেখো আজকে যদি সত্যিটা বলে দিতাম তাহলে যেই জিনিসটা এতো সহজে মিটেছে সেটা কিন্তু এতো সহজে মিটতো না। সবাই ওদের উপর রাগ করে থাকত। হয়তো ওদের বিয়েটাও আর কখনো মেনে নিতো না। তাই ভাবলাম আমরা চরিত্রগুলোই নাহয় অদল বদল করে নি। এতে বাবা মা আমাদের উপর রাগ করলেও সেটা স্থায়ী হবে না কারণ এতোদিনে তাদের হৃদয়ে তুমি আর আমি এতটুকু জায়গা তো বানিয়েই নিয়েছিলাম। আর আমাদের একটা সেফটি ছিলো আমাদের বিয়েটা হয়েগেছিলো তাই তিনমাস আগে যেটা করেছি সেটা এতো হাইলাইট হতোও না তাই ভেবেই এতো প্লান। ”

আমার চোখ খুশিতে চকচক করে উঠলো,
“ওয়াও জাস্ট মাইন্ড ব্লোইং আমি তো এই প্লান ভাবতেও পারতাম না। ”
শান কিছুটা টোন কেটে বললো,
“মাথায় যদি গোবর ভরা হয় তাহলে এসব প্লান মাথায় আসবে কেমনে? ”
উনার কথা শুনে আমি উনার দিকে তেড়ে গিয়ে উনার কলার ধরে বললাম,
“কি বললেন আপনি? ”

শান আমার কোমড় দুইহাতে জড়িয়ে ধরে আমাকে একটু উনার কাছে নিয়ে আসলেন আর ঠোঁট কামড়ে হেসে বললেন,
“কিছু বলিনি তো তবে এভার বলবো। ”
হঠাৎ উনার কন্ঠে অন্যসুর শুনে আমি উনার কলার ছেড়ে সরতে চাইলাম তখনই উনি আমাকে বললো,
“কি এইমাত্রই তো শেরনী হয়ে ছিলে এরমধ্যেই ভেজা বিল্লি হয়ে গেলে। এতো রূপ বদলাও কেন?”
আমি ধীর কন্ঠে বললাম,
“কোনো রূপ বদলাইনি । ”
“বদলেছো তোমার এই নতুন নতুন রূপে আমি তোমার মাঝে নতুন করে বারবার হারিয়ে যাই আর তোমার সব রূপেই আমি তোমার জন্য পাগল হয়ে যাই। ”
“আচ্ছা এভার ছাড়ুন। ”
“নো এতোটা হেল্প করলাম আমার পাওনাটা বুঝিয়ে দেও আর তারউপর তখনকার ক্ষতিপূরণও তো আছে তাই এখন তুমি আমাকে দুটো কিস করবে হুম নাউ শুরু করো। ”
উনার কথা শুনে আমার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। এমন ভাবে বলছে যেন ছোট বাচ্চা চকলেট চাইছে।
“বাসাভর্তি মানুষ নিচে কে কি ভাববে। এখন না পড়ে দেবো কেমন? ”
“স্যরি বাকির নাম ফাঁকি সোনা আর এইমাত্র আমি এই কথা বলায় কে যেন বলছিলো যে কোনো সমস্যা নেই তাহলে এখন কি হলো। ”

আমি নিজের চোখ সরিয়ে নিলাম। উফ এভাবে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারবো জানলে জীবনেও আসতাম না এখানে। শান আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
“কি হলো শুভ সময়ের অপেক্ষা করছ নাকি? তাড়াতাড়ি করো। ”

আমি তখনও চুপ ছিলাম। শান আবারও বললো,
“বুঝেছি তোমাকে দিয়ে হবে না আমাকেই করতে হবে। ”
ওনার কথা শুনে আমি দ্রুত বলে উঠলাম,
“না লাগবে না আমি করব। ”
“শিউর। ”

আমি মাথাটা উপর নিচ নাড়ালাম। মুখ গোমড়া করে বললাম,
“এটা একটু বেশী হয়ে যাচ্ছে না পাওনা হিসেবে। ”
“একদমই না এতো হেল্প করলাম এতটুকু তো পেতেই পারি। এইবার কথা না বাড়িয়ে শুরু হয়ে যাও। ”
“আগে আপনি চোখ বন্ধ করেন। ”
“চোখ বন্ধ করতে হবে কেন?”
আমি রেগে বললাম,
“তাহলে কিস করতে পারবো না। ”
শান হেসে বললো,
“ওকে ওকে এতো রাগ করার কিছু নেই। এই নেও বন্ধ করলাম। ”

শান চোখ বন্ধ করতেই আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম উনার দিকে। আমার হৃদপিন্ডটা এতো জোরে জোরে সংকোচন প্রসারণ হচ্ছে বলার বাহিরে। আমি আস্তে করে উনার গালে ঠোঁট ছোঁয়ালাম। হঠাৎ উনার হাতটা আলগা হয়ে আসতেই আমি উনাকে একটা ধাক্কা দিয়ে দরজাটা খুলে বাহিরে চলে গেলাম। আর খিলখিলিয়ে হেসে বললাম,
“এতটাই পাওনা ছিল। ”
শান কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,
“এটা কিন্তু চিটিং হলো এখনি এসো বলছি। ”
আমি হেসে বললাম,
“আপনি বললেই হলো নাকি কোনো চিটিং হয়নি। ”
তারপর আমি নিচে চলে গেলাম।শান নিজের গালে হাত দিয়েই মুচকি হাসল।


নিচে গিয়ে আবার সবার সাথে আড্ডায় যোগ দিলাম। কারো কথা যেন আজ ফুরাচ্ছেই না। এভাবেই কথাবার্তা বলতে বলতে কখন যে রাত বারোটা বেজে গেল কারোরই জানা নেই। আমার বাবা, মা, আপু খাওয়া দাওয়া করে বেরিয়ে পড়ল। যাওয়ার আগে অবশ্য আপু আমাকে জড়িয়ে বলেছিলো,
“তোদের কি বলে ধন্যবাদ দেবো জানা নেই আজ যদি তোরা না থাকতি আমাদের কি হতো গড নোজ। নিজেদের ঘাড়ে দোষ নিয়ে আমাদের বাঁচিয়ে দিলি। তুইও যেমন শান ভাইয়াও তেমন সত্যিই পারফেক্ট জুটি তোরা।সারাজীবন তোদের যেন এভাবেই দেখি সেই প্রার্থনা করি। ”

আমি আপুর কথার বিপরীতে কিছু না বলে শুধু হাসলাম। সত্যিই শানের মতো মানুষকে হাজবেন্ড হিসেবে পেয়ে আজ নিজেকে ধন্য মনে হচ্ছে।

ঘুমে আমার কিছুই ভালো লাগছিলো না শুধু অপেক্ষা করছিলাম কখন গিয়ে বিছানায় শুবো। আমি একজগ পানি নিয়ে রুমের দিকে যাচ্ছিলাম তখনই ভূমিকা আপু এসে আমার হাত ধরে আড়ালে নিয়ে গেল। হঠাৎ এমন হওয়ায় আমি ভয় পেয়ে বললাম,
“কি হয়েছে এমন করছো কেন? ”
“কিছু হয়নি আমি তো শুধু একটা কথা জানার জন্য তোমাকে এখানে এনেছি। ”
আমি অবাক হয়ে বললাম,
“কি কথা? ”
ভূমিকা আপু সরু চোখে তাকিয়ে বললে,
“স্মৃতি আর আরশের কথা গুলো মিথ্যা তাই না। তোমরা ওদের বাঁচিয়েছো। ওরা দুজন বিয়ের আসর থেকে একসাথে পালিয়েছিলো? ”
ভূমিকা আপুর কথায় ভয় পেয়ে গেলাম কি বলবো? উনি যদি এসব বাবা, মা কে বলে দেয়। ভূমিকা আপু বললো,
“কি হলে বলো?”
“না তো কে বলেছে তোমায়?”
“দেখো মিথ্যা বলবে না আমি কিন্তু বুঝেছি।”
আর কোনো উপায় না পেয়ে বললাম,
” প্লিজ আপু এই কথা যেন বাবা,মা না জানে। ”
ভূমিকা আপু হেসে বললো,
“পাগলি কেন বলবো? আমি তো জাস্ট বিষয়টা শিউর হওয়ার জন্য তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি বর কিছুই না। এইবার রুমে যাও। ”

ভূমিকা আপু যেতেই আমি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলাম তারপর রুমে চলে গেলাম। রুমে গিয়ে দেখলাম রুমে শান নেই হয়তো ওয়াসরুমে। আমি গিয়ে চিৎপটাং হয়ে কোনো রকম চাঁদরটা গায়ে দিয়েই শোয়া মাত্র ঘুম। হঠাৎ চাঁদরে কারো জোরে টান পড়তেই আমি ভয়ে ঘুম থেকে উঠে গেলাম আর রেগে তাকিয়ে থাকলাম মানুষটার দিকে। ইচ্ছা করছে এখনই লবন মরিচ ছাড়া কাঁচা চিবিয়ে খাই।
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here