তোকে দিয়েছি মন পর্ব ৩৫+৩৬

তোকে_দিয়েছি_মন❤
৩৫.৩৬
পর্ব – ৩৫
Writer: Sidratul muntaz

🍂
ঈশান আগুন গরম দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। এই বুঝি গিলে খেয়ে ফেলবেন আমায়। আমার দৃষ্টি অন্যদিকে। উনার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকার সাহস ইচ্ছে বা রুচি…. কোনোটাই আমার অবশিষ্ট নেই। ঘৃণা হচ্ছে উনাকে। একটা মানুষের চরিত্র যে এতোটা ভয়ংকর হতে পারে সেটা উনাকে না দেখলে আমার জানা হতো না। রাগে দুঃখে চোখ দিয়ে অঝোরে পানি আসছে। আমি রীতিমতো নিজের সাথে যুদ্ধ করছি চোখের পানিগুলো আটকে রাখার। আর কত মেয়ের মন নিয়ে এইভাবে খেলবেন উনি? যদি সত্যিই এই নরক থেকে বের হতে পারি তাহলে আমার প্রথম কাজ হবে উনার নামে মামলা করা। ফাসি না হোক অন্তত যাবজ্জীবন কারাদন্ড নিশ্চিত করা। একটা মানুষকে খুন করলে সেই খুনীর ফাসি হয়। তাহলে একজন মানুষের মনকে যে খুন করবে তারও কি ফাসি হওয়াটা যৌক্তিক নয়? মন মরে গেলে সেই মানুষটাও যে বেচে থাকার আশা হারায়। তাহলে এটাও তো পরোক্ষভাবে মার্ডার কেসই হলো! বাস্তবতার আইন অনুযায়ী উনি ফাসির আসামী নাহলেও আমার মনের আদালতের কাঠগড়ায় উনি ফাসির আসামী। একজন খুনি। প্রয়োজন হলে আমিই উনাকে খুন করে নিজের মনের খুনের বদলা নিবো। ঈশানের তীক্ষ্ণ ধমকের শব্দে কেপে উঠলাম আমি–

তারা এসব আমি কি শুনছি??সায়েদ আঙ্কেল বললেন তুমি নাকি উনাকে টেক্সি ভাড়া করে দিতে বলেছো? চট্টগ্রাম চলে যেতে চাও? তাও আবার আমি যেন জানতে না পারি! কেনো? হোয়াই? হঠাৎ এইরকম সিদ্ধান্তের কারণ কি তোমার?

আমি এখনো চোখমুখ কঠিন করে একইভাবে অন্যদিকে তাকিয়ে আছি। ঈশান আমার কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে হতাশ হলেন। মাথা নিচু করে বিছানার উপর আমার পাশে বসলেন। আমার গালে আলতো করে হাত রেখে খুব নরমভাবে জানতে চাইলেন–

তারা কি হয়েছে তোমার? কেনো এমন করছো? তোমাকে এইভাবে দেখে যে আমার ভেতরটা ঝলসে যাচ্ছে সেটা কেনো বুঝো না তুমি ? নিজেকে কষ্ট না দিয়ে প্লিজ সেই কষ্টের ভাগ টা আমাকেও নিতে দাও। কবে তোমার কষ্টের ভাগিদার হওয়ার সৌভাগ্য হবে বলোতো? মনের কষ্ট নিজের মধ্যে দমিয়ে না রেখে আমার উপর ঢেলে দাও প্লিজ!! আমার বুকে আছড়ে পড়ে কেদে ভাসাও তাও ভালো। তবুও এইভাবে গুম মেরে থেকো না। বড্ড কষ্ট হয় বিশ্বাস কর। নিজেকে তুচ্ছ মনে হয়। আমি থাকতে আমার তারার এতো কষ্ট! এটা আমি কিভাবে মেনে নেই বলো?

আমার কোনো কষ্ট নেই। একদম ঠিকাছি।

মিথ্যে কেনো বলছো তারা?

কিচ্ছু মিথ্যে বলছি না আমি। কোনো কষ্ট নেই আমার। তবে রাগ আছে… ঘৃণা আছে..আপনার উপর( আঙুল ইশারা করে) আপনাকে ঘৃণা করি আমি। আপনার সাথে এক ছাদের তলায় থাকতে চাই না। এই বাড়িটা আমার জন্য আস্তো এক নরক। এই নরক থেকে মুক্তি চাই আমি। আপনার মতো রাক্ষসের থেকে মুক্তি চাই। দেবেন মুক্তি?? দেবেন?

ঈশান আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমি ভ্রু কুচকে বললাম–

কি হলো? এখন কোনো কথা বলছেন না কেনো? আমাকে কষ্ট পেতে দেখলে আপনারও তো খুব কষ্ট হয় তাইনা? তাহলে মুক্তি দিতে পারবেন না কেনো? এখানে থাকতে কষ্ট হচ্ছে তো আমার! আপনার সান্নিধ্যে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ কষ্ট…. যন্ত্রণা হচ্ছে। দম আটকে আসছে বুঝেন না? এখন এই কষ্ট থেকে বাচান আমায়….. মুক্তি দিন আপনার শিকল থেকে। সারাজীবনের জন্য আপনাকে ছেড়ে চলে যেতে দিন আমায়……

চিৎকার করে কথাটা বলতে নিতেই ঈশানের শক্ত হাতের চড় খেয়ে বিছানার বিপরীত পাশে ঝুকে পড়তে হলো আমায়। ব্যাথায় গালটা থরথর করে কাপছে। অসম্ভব জ্বালাপোড়া করছে। যেন জ্বলন্ত কোনো পাত্র ঠেসে রাখা হয়েছে গালের উপর। সেই সাথে চোখের পানিগুলো গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ায় যন্ত্রণার তীব্রতা আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঈশান আমার এক হাত ধরে টেনে তুললেন। উনি আমার দুই গাল শক্ত করে চেপে ধরতেই ব্যথায় কুকিয়ে উঠলাম আমি। আরো অসহ্যরকম যন্ত্রণা হচ্ছে এবার। ঈশানের চোখেমুখে হিংস্রতা দেখতে পাচ্ছি। দাতে দাত চেপে ঈশান বললেন—

আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করলেও তোমাকে এর পরিণাম ভুগতে হবে। ছেড়ে যাওয়া তো অনেক দূরের ব্যপার। আমার চোখের আড়ালও হতে পারবে না তুমি। প্রয়োজন হলে একদম খালাস করে ফেলবো। তোমাকে নয়…. নিজেকে। আমার লাশের উপর দিয়ে এ বাড়ি ছেড়ে যাবে তুমি। তোমাকে ছাড়া জীবন্ত লাশ হয়ে বেচে থাকার চেয়ে একবারেই মরে যাব…..তাও ভালো। হাজারগুণে ভালো।

আমার খুব কষ্ট হচ্ছে ঈশান। ব্যাথা লাগছে। ছাড়ুন প্লিজ।

অসহায়ের মতো অস্পষ্টভাবে উচ্চারণ করলাম আমি। ঈশান তৎক্ষণাৎ আমাকে ছেড়ে দিলেন। আমি মাথা নিচু করে বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম। মুখ নাড়াতে পারছি না ব্যথায়। হয়তো গালের কিছু অংশ ফুলে উঠেছে । ঈশান হঠাৎই আমার কাছে আসলেন। আমি পিছিয়ে গেলাম কিছুটা। উনি আরো এগিয়ে এসে এবার আমার উপর ঝুকে পড়লেন। উনার চোখ দুটো টলমল করছে। যেন পলক ফেললেই জল গড়িয়ে পড়বে। আমাকে চড় মেরে আমার চাইতেও দিগুন ব্যাথা যেন উনিই পাচ্ছেন। কিছুক্ষণ ছলছল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে আক্ষেপের সুরে বলে উঠলেন–

এক্সট্রিমলি সরি!!

আমি কোনো উত্তর দিলাম না। বিছানার সাথে মিশে রইলাম। আর উনি? যেনো আমাতে মিশে যেতে চাইছেন। আমার লাল টুকটুকে ফুলে থাকা গালটায় কিস করছেন। আগুন গরম হয়ে পুড়ে থাকা গালটা উনার ঠোটের পরশে যেন খানিকটা শীতল হতে চাইছে। কিন্তু আমার মনটা যে এই যন্ত্রণাদায়ক পরশ সহ্য করতে পারছে না। বিষাক্ত লাগছে মনের। আমি নিশ্চুপ হয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পর হঠাৎ ছটফট শুরু করলাম। উনি আমার ছটফটানির তোয়াক্কাও করলেন না। আরো শক্ত করে চেপে ধরলেন। এখন নড়তে গেলেও পেশিতে ব্যথা হচ্ছে। আর কিছুক্ষণ এই টর্চার সহ্য করলে আমি মরেই যাবো। আপ্রাণ চেষ্টা করছি যেকোনো শাহারায় উনার থেকে মুক্তি পাওয়ার। তখনই মেঘনা চাইতে বৃষ্টির মতো আমার ডান হাত টেবিলের উপর সাজানো কাচের ফ্লাওয়ার বাজটার স্পর্শ পেল। পৈশাচিক একটা হাসি দিয়ে বাজটা তুলে নিলাম আমি। আমাতে মগ্ন ঈশানের সেই হুশ নেই। এই সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়ে ফ্লাওয়ার বাজটা দিয়ে আঘাত করলাম উনার মাথার পেছন দিক বরাবর। উনি হালকা শব্দ করে মাথা চেপে ধরলেন। ভাঙা ফ্লাওয়ার বাজটা মাটিতে ছুড়ে ফেলেই এবার উঠে দাড়ালাম আমি। পেছন ফিরে না তাকিয়ে এক দৌড়ে বেরিয়ে গেলাম রুম থেকে। উনি আমার নাম ধরে চিৎকার করছেন। আমি সেই চিৎকার সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ছুটে যেতে লাগলাম। ঈশান এবার ডায়না রাকেশী বাবর্চি আঙ্কেল সবার নাম ধরে ডাকা শুরু করলেন। আমি দ্রুতপায়ে সিড়ি দিয়ে নেমে যেতেই ডাইনিকে চোখের সামনে দেখতে পেলাম। মেয়েটাকে দেখেই আমার ইচ্ছে হলো দুই হাতে ইচ্ছেমতো থাপড়াতে। কিন্তু আমায় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নিতে হল। পেছনে যে রাকেশী, বাবর্চি আঙ্কেল, বাগানের মালী সালাম চাচা, ড্রাইভার ভাই তৌফিক, এমনকি মেইন গেইটের গার্ডও জড়ো আছে। ওদের সবাইকে একসাথে দেখে ভয়ে আমার আত্মার পানি শুকিয়ে আসে। না জানি এবার কি হাল হবে আমার। ভয়টাকে কোনোমতে কাটিয়ে উঠার প্রচেষ্টা চালিয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে আমি খুব অস্থির গলায় বলে উঠলাম —

আপনারা সবাই থাকেন কই?? জলদি ঈশানের রুমে যান। উনার মাথা ফেটে গেছে। রক্তপাত হচ্ছে। খুবই ডেঞ্জারাস অবস্থা।

ঝড়ের গতিতে কথাটা আমার বলতে দেরি হল কিন্তু উনাদের হুড়মুড়িয়ে ছুটে যেতে যেন এক মুহুর্তও দেরি হল না। এই সুযোগে আমি দৌড়ে গেলাম মেইন গেইটের দিকে। পুরো জায়গা নিরব দেখে নির্দ্বিধায় সদর দরজার বাহিরে বেরিয়ে এসেছি। এবার আমি মুক্ত। ভাবতেই ভাল্লাগছে! আরো জোড়ে দৌড়ানো শুরু করলাম। মুক্ত পাখির মতো ছুটে যেতে লাগলাম। ভাগ্য আমায় কোন গন্তব্যে নিয়ে যাবে আমি জানিনা….. শুধু আপনগতিতে ছুটে যাচ্ছি!
🍂

তোকে_দিয়েছি_মন❤
পর্ব – ৩৬
Writer: Sidratul muntaz

🍂
গাছের নিচে গুটিশুটি মেরে বসে আছি অনেকক্ষণ ধরে। আশেপাশের পরিবেশ দেখে বোঝা যাচ্ছে এইটা খুব দৃষ্টিনন্দন একটা পার্ক। মায়েরা বাচ্চাদের এখানে খেলাধুলা করতে নিয়ে আসে। বয়স্ক মানুষেরা বিকালে হাটতে আসে। এখন অবশ্য সন্ধ্যা নামতে চলেছে। জন সমাগমও কমে আসছে। জায়গাটা ক্রমশ নিরব আর অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। সেই সাথে আমার মনের ভয়টাও বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রবলভাবে। কি জানি কি হয় টাইপ একটা আশংকা অচিরেই বাসা বেধে নিয়েছে আমার মনে। প্রায় এক ঘণ্টা আগে ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে এই পার্কের একটা বেঞ্চে এসে বসেছিলাম আমি। অস্থির ছিলাম খুব। হুট করেই শুরু হল বৃষ্টি। তাতে আমার শরীরের অর্ধেক অংশ ভিজে গেছে। বাধ্য হয়েই এই বিরাট গাছটার নিচে আশ্রয় নিতে হয়েছে আমায়। ওরনা দিয়ে সম্পুর্ন শরীর আবৃত করে বসে আছি তবুও ঠান্ডায় পুরো শরীর থরথর করে কাপছে। ঠান্ডা লেগে গেছে। ইতিমধ্যে দু একটা হাচিরও দেখা পেয়েছি। এবার শুধু জ্বর আসাটা বাকি। এই নাজেহাল অবস্থা থেকে কিভাবে মুক্তি পাবো জানা নেই। তবে চারিপাশে অজস্র চক্ষুর বিষাক্ত নজরের সাথে ভয়ানক বিপদের আভাসটা বেশ ভালো মতোই টের পাচ্ছি আমি। যেকোনো সময় হামলা হতে পারে আমার উপর। সেই ভয়েই প্রাণপাখিটা আমার ডানা ঝাপটাতে শুরু করেছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। আমি নিজেকে যথাসম্ভব গুটিয়ে রাখার চেষ্টা করছি। কিন্তু অন্ধকার যত নামছে আমার আশেপাশের পরিবেশ ততই বীভৎস রুপ ধারণ করছে। একটা লোককে বেশ কিছুক্ষণ ধরে খেয়াল করছি আমার চারিদিকে ঘুরঘুর করছে। খুবই বিদঘুটে চেহারা। দেখলেও শরীরের লোম দাড়িয়ে যায়। গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে। লোকটা আমার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছে যে আমার রাগে কান্না আসছে। ইচ্ছে করছে সামনে গিয়ে বদমাশটার মুখে উরাধুরা খামচে দিয়ে আসি। তাও যদি মনের জ্বালা মিটে। গাছের সাথে পিঠ লাগিয়ে চোখ বন্ধ করে বসলাম। যেন বিরক্তিকর চেহারা গুলো না দেখতে হয়। এমন সময় কেউ আমায় ডাক দিল।

ও মেয়ে!!

ভ্রু কুচকে চোখ মেললাম। এ তো দেখছি ওই বদমাইশটা। সাথে সাথে নিজেকে জড়োসড়ো করে বসে পড়লাম আমি। বুকটা ধুকধুক করছে। আমার ধুকপুকুনি আরও বেড়ে গেল যখন সামনে দাড়ানো লোকটা বিছরি দাতগুলো বের করে হেসে উঠল। টুথ পিক দিয়ে দাতে খোচাতে খোচাতে আমায় জিজ্ঞেস করছে —

একা নাকি??

আমি ভয়ার্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছি। মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না আমার। কণ্ঠনালি পর্যন্ত কাপছে। আমার চোখেমুখের আতঙ্কটা বুঝতে পেরে আরেকবার বিদঘুটে একটা হাসি দিলেন উনি।

আহহ….. কতদিন পর একটা মনের মতো ছবি পাইলাম। কি অপুর্ব ছবি!

কথাটা শুনে আমার ইচ্ছে করছে এখনি ছুটে পালিয়ে যেতে। কিন্তু উঠে যাওয়ার শক্তি যোগাড় করতে পারছি না। মনে হচ্ছে দৌড়াতে গেলেই হোচট খেয়ে পড়ে যাবো। আর তখনি এই লোকটি আমায়….কান চেপে জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলাম আমি। আমার চিৎকারে লোকটা যেন পিশাচের রুপ ধারণ করল। চোখ রাঙিয়ে ধমক দিয়ে বলল–

ওই চুপ!! একদম চুপ।

বলতে বলতে পকেট থেকে ধারালো ছুড়িটা অর্ধেক বের করে আমায় দেখিয়ে আবার পকেটে ভরে রাখল৷ আমি এবার বিস্ফোরিত চোখে লোকটার দিকে তাকালাম। আমার ভয় পাওয়া দেখে আরেকবার হাসলেন উনি। ইশশ কি ভয়ংকর হাসি। চোখ দিয়ে পানি ঝরছে আমার। কিন্তু শব্দ করে কেদে উঠতে পারছি না। এতেও যেন আমার শ্বাস আটকে আসছে। লোকটা হঠাৎ খুব তীক্ষ্ণ আওয়াজ করে শিষ বাজালো। শিষের শব্দে ছটফট করে উঠলাম আমি। মুহুর্তেই আরো কতগুলো অদ্ভুত চেহারার মানুষ জড়ো হয়ে গেল আমাকে ঘিরে। আমায় দেখে সবাই পৈশাচিক হাসি হাসছে। আমি গাছের সাথে মিশে যাচ্ছি। পারলে গাছটাকে ছেদ করে ভেতরে ঢুকে যাই। একটা লোক শব্দ করে উচ্চারণ করল–

বস! তুইলা নিমু?

হাতে টুথপিকওয়ালা লোকটা দাত কেলিয়ে বলে উঠল—

অবশ্যই! লগে কেউ নাই। রাস্তা ক্লিয়ার। তাইলে সবুর কিয়ের?

কথাটা শেষ হতেই শব্দ করে হেসে উঠল সবাই। তাদের হাসির বিষাক্ত শব্দে আমার কান জ্বালাপোড়া করছে। আমি চিৎকারও করতে পারছি না। অদ্ভুত ভাবে শব্দগুলো গলার ঠিক মাঝ বরাবর এসে আটকে যাচ্ছে। পাশ থেকে একজন বলে উঠল–

ওই সজল! যা জিপটা লইয়া আয়।

আরেকজন বলল– আগে তো মুখ বানতে হইবো

উনার সাথে তাল মিলিয়ে আরো কয়েকজন বলে উঠল– ঠিক!

কিছক্ষনের মধ্যেই খেয়াল করলাম একজন মোটা কাপড় হাতে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আরেকজন যাচ্ছে জিপগাড়ি আনতে। আমি অসহায় দৃষ্টিতে সবাইকে দেখে চলেছি। মাথা কাজ করছে না। হাত পা রাতারাতি অবশ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে আজই আমার জীবনের শেষ দিন। চোখ খিচে গলা ছেড়ে চিৎকার করতে চাইলাম ওমনি সামনে থেকে একজন চেচিয়ে উঠল।

সব পালা! বড় গাড়ি আইতাসে! ওই পালা পালা ভাগ ভাগ!!!

হৈ হৈ করতে করতে যে যার মতো চলে যেতে লাগল। আমি হা করে তাকিয়ে আছি। চোখের পলকেই পরিবেশ টা শান্তরুপ ধারণ করল। এক চিলতে আলো চোখে পড়তেই হাত দিয়ে চোখ ঢেকে নিলাম আমি। গাড়ি ব্রেক করার আওয়াজ পেয়ে আড়চোখে তাকালাম। খুব লম্বা একটা অবয়ব দেখা যাচ্ছে। এই অবয়ব টা আমার ভীষণ পরিচিত। আরো কিছুটা এগিয়ে আসতেই ঈশানের চেহারা দেখতে পেলাম আমি। অজান্তেই মুখে হাসি ফুটে উঠল। স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস নিয়ে দৌড়ে গেলাম ঈশানের দিকে। শক্ত করে উনাকে জড়িয়ে ধরে কেদে ফেললাম। ঈশানও আমাকে উনার বাহুতে বন্দী করলেন। আমার মাথায় চুমু দিয়ে বলে উঠলেন —

পাগল বানিয়ে ছাড়বে আমায়? অনেক জ্বালিয়েছো তারা এবার বাসায় চলো।

বাড়ি চলো কথাটুকু শুনেই ভ্রু কুচকে তাকালাম আমি। সাথে সাথে উনাকে ধাক্কা মেরে দুরে সরিয়ে দিলাম। আমার গাছের সাথে গিয়ে দাড়ালাম। আমি কিছুতেই উনার সাথে যাবো না! দরকার হলে গাড়ি চাপা পড়ে মরে যাবো তবুও উনার সাথে যাবো না। ঈশান আমার হাবভাব আন্দাজ করতে পেরে ধমক দিয়ে বললেন—

তারা কি হয়েছে?? দেখো আর কোনো এক্সকিউজ শুনতে চাইনা আমি। তুমি এক্ষুনি আমার সাথে গাড়িতে উঠবে….( মাথায় হাত দিকে কুকিয়ে উঠলেন)

আমি এতোক্ষনে খেয়াল করলাম উনার মাথা ব্যন্ডেজ করা। মনে হচ্ছে তখন খুব মারাত্মক চোট পেয়েছিলেন। নিজের উপরই এবার রাগ হচ্ছে আমার। কেনো মারতে গেলাম উনাকে?? উনি মাথায় হাত রেখে করুণ কণ্ঠে বললেন–

দেখো তারা! জ্ঞান ফিরে আসার পর যখন জানতে পারলাম তুমি পালিয়েছো… ( চোখ বন্ধ করে একটু থেমে) মাথায় আঘাত নিয়েও তোমাকে খুজতে বেরিয়েছি। অবশেষে খুজে পেয়েছি। প্লিজ তারা এমন করো না। দয়া করে হলেও বাসায় চলো আমার সাথে।

ঈশান ভাইয়া টলছেন। ঠিক মতো দাড়িয়ে থাকতে পারছেন না। মনে হচ্ছে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাবেন। আমি ধীরে ধীরে উনার কাছে গিয়ে দাড়ালাম। উনাকে ধরার চেষ্টা করতে করতে বললাম—

দেখুন আমি আপনার সাথে বাড়ি যেতে পারবো না। কিন্তু…..

আর কিছু বলার আগেই হঠাৎ আমায় ঠাস করে চড় দিলেন উনি। মুহুর্তেই আমার চারিদিক ঘুরে আসল। বেহুশের মতো উনার বুকের উপর ঢলে পড়লাম আমি। উনি আমায় কোলে তুলে গাড়িতে উঠালেন। আমি চোখ বন্ধ করে তব্দা লেগে আছি। কোনো শব্দও কানে আসছে না। পুরো দুনিয়া সাইলেন্ট হয়ে গেছে আমার।

.

.

যখন জ্ঞান ফিরল তখন আমি ঈশানের বিছানায় বসে আছি। মাথা তুলে উঠতে নিতেই গালে ব্যাথা হল আমার। উফফ কি মারাত্মক ব্যাথা করছে। বাম পাশে থাকা ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় তাকিয়ে দেখলাম গালটা ফুলে ডিব্বা শেপ হয়ে আছে আমার। গলা দিয়ে অদ্ভুত শব্দ বের করে গালে হাত রাখলাম আমি। ভ্রমর কামড়ালেও তো এইরকম বীভৎস অবস্থা হয়না। দুই দুইবার একই গালে চড় খেয়ে গালটা প্রায় ঝাঝরা হয়ে গেছে। কতদিন এই দাগ থাকবে কে জানে?? তার থেকেও বড় কথা হলো পুরো গাল জুড়ে অসম্ভব জ্বালাপোড়া করছে। এই যন্ত্রণাই বা কখন শেষ হবে? গালে হাত রেখে কান্না শুরু করলাম আমি। এতোটা নিষ্ঠুরভাবে কেউ মারে? দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন ঈশান ভাইয়া। উনাকে দেখে গালটা আরো একটু ঢেকে নিলাম আমি। মাথায় ব্যন্ডেজ পড়েও কতটা সুন্দর লাগছে উনাকে। সাদা ব্যান্ডেজের সাথে ব্ল্যাক সিল্কি চুলগুলোর দারুণ একটা কম্বিনেশন। আমি আমার দৃষ্টি সংযত করে অন্যদিকে তাকালাম। উনি নিঃশব্দে দরজা আটকে আমার সামনে বসলেন। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন–

হাতটা সরাও।

কি?

গাল থেকে হাত সরাও।

কেনো? আবার মারবেন?

উনি পলক ঝাকিয়ে বললেন– না।

আমি হাত সরিয়ে দিলাম। উনি এবার মলম লাগানো শুরু করলেন। মলমে জ্বলুনি আরো বেড়ে যাচ্ছে। আমি মুখ কুচকে উচ্চারণ করলাম– উহহ!

উনি একটু থেমে আবার লাগাতে শুরু করলেন। কিছু সময় পর মলম লাগানো শেষ হল। মলমের টিউবটা ড্রয়ারে রেখে টেবিলের সাথে ঠেস দিয়ে দাড়ালেন উনি। আমার দিকে পূর্ণদৃষ্টি নিক্ষিপ্ত রেখে হাত ভাজ করে বলে উঠলেন —

কি দরকার ছিল এতো কাহিনি করার?? তুমি কি চাও বলোতো?? আমাকে মেরে ফেলতে চাও? তাহলে নাও এখনি মেরে ফেলো। ধুকে ধুকে মরার চাইতে একেবারে মরে যাওয়াই ভালো।

আমি তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলাম– একই কথা আমিও আপনাকে বলতে পারি। বারবার এই ছোট্ট মনটায় আঘাত না করে একদম মেরেই ফেলুন না আমায়। এই যন্ত্রণা আমি আর নিতে পারছি না।

মানে? ( ভ্রু কুচকে)

আমি আরেক দফা হেসে বললাম– আচ্ছা আপনি কয়জনকে ভালোবাসেন?? আসলে কাকে সত্যিকারের ভালোবাসেন?? আমাকে? জায়মাকে? নাকি ডায়নাকে?

হোয়াট?

আমার কথা শুনে যেন সপ্তম আসমান থেকে পড়লেন উনি। কি নিখুঁত অভিনয়!

এখন আবার ডায়না কোথ থেকে আসলো? তারা তুমি কি মিস ডায়নাকে মিন করছো?

মিস ডায়না?? বাহ! খুব সুন্দর। মাঝরাতে যে হয় আপনার ডানু…. সুইটহার্ট…. আমার সামনে বুঝি সে মিস ডায়না?

ঈশান ভাইয়া কপালে বিস্ময়ের ভাজ নিয়ে হা করে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। হঠাৎই সামনে এসে বাম হাতটা হালকা উচু করে ধমকের সুরে বললেন—

দেই আরেকটা চড়?

আমি কেপে উঠে গালে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলাম। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম চড় মারছে না। তাই আবার সোজা হয়ে বসলাম। উনি এবার দরজা খুলে চেচিয়ে ডায়নাকে ডাকছেন। উফফ উনার চিৎকার শুনে শুনে কানটার আমার বেহাল দশা। এখন আবার ডায়না ডেকে কি ড্রামা শুরু করবে কে জানে? ডায়না হাজির হতেই উনি বলে উঠলেন —

মিস ডায়না! আপনার সেলফোনটা বের করুন। কালরাতের মেসেজটা আপনার ম্যামকে দেখান।

উনার কথা শুনে আমি আর ডায়না দুজনেই চমকে উঠলাম। তবে ডায়না একটু বেশিই চমকে উঠল। সেই সাথে ভয়ও পাচ্ছে মেয়েটা। ঈশান ভাইয়া আবার ধমক দিলেন–

ডু ফাস্ট! ওপেন ইউর মেসেন্জার।

ডায়না কেপে উঠে চটজলদি স্কার্টের পকেট থেকে ফোনটা বের করল। কাপা কাপা হাতে ফোন থেকে কি একটা বের করে ঈশানের হাতে দিল সে। মেয়েটার মুখটা শুকিয়ে এতোটুকু হয়ে আছে। মনে হচ্ছে খুব ইতস্তত বোধ করছে সে। যেন এখনি অপমানে কেদে দিবে মেয়েটা। ঈশান ডায়নার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে আমার মুখের সামনে ফোনের স্ক্রিন তুলে ধরলেন। আমি মোবাইলটা হাতে তুলে নিলাম।

প্লিজ ডোন্ট ক্রাই।🥺🥺🥺 ট্রাস্ট মি,,, আই লভ ইউ আ লট।😍😍😍❤ হ্যা জানি আমার বিয়ে হয়েছে। 😶কিন্তু বিয়েটা আমি ইচ্ছে করে করিনি।😐 বাধ্য হয়ে করতে হয়েছে। 😭আমি এখনো শুধু তোমাকেই ভালোবাসি ডানু!😘 প্লিজ এইভাবে আপসেট হয়ে থেকো না। 😔তোমার গোংরা মুখ দেখতে আমার একদমই ভালো লাগে না।😢😭 সবসময় হাসিখুশি থাকবে তুমি।😊 এটাই আমার চাওয়া।😍 খুব শীঘ্রই মেয়েটাকে ডিভোর্স দিয়ে তোমাকে বিয়ে করবো। 😍😍😘আমার বাড়ির বউ হবে তুমি।👰 ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড সুইটহার্ট? 💘গিভ মি আ কিস নাউ।😁😍😋

কালকের কথাগুলোই মেসেজে হুবুহু কপি করে লেখা ফেসবুক মেসেঞ্জার থেকে পাঠানো হয়েছে মেসেজটা। আমি আইডিটার নাম পড়ে নিলাম– “শাহিদ মির্জা” এটুকু দেখেই কৌতুহলী দৃষ্টিতে ঈশানের দিকে তাকালাম। ঈশান রাগান্বিত চোখে আমাকে দেখে হুট করে ফোনটা কেড়ে নিলেন। রাগে রীতিমতো ফুসছেন উনি। ডায়নার হাতে ফোনটা তুলে দিয়েই উনি বললেন—

ইউ ক্যান লিভ নাউ।

ডায়না চোখের পলকে বেরিয়ে গেল। ঈশান ঠাস করে দরজাটা আটকে আমার সামনে এসে বসলেন। উনার অগ্নিদৃষ্টি দেখে আমি ঢোক গিলে মাথা নিচু করে নিলাম। উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে সামলে নিয়ে মুখে হাত রাখলেন। কিছুক্ষণ শান্ত হয়ে বসে রইলাম দুজন। পুরো রুম এখন পিন ড্রপ সাইলেন্ট।
🍂

চলবে

( ডাইনির প্রেম কাহিনি আমরা কালকে শুনবো ঈশানের মুখ থেকে। )খ

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here