মেঘের পরে মেঘ-৭

মেঘের পরে মেঘ -৭

শায়েরী রান্নাঘরে ব্যস্ত।আটার খামির তৈরি করছে।আজ নাবিল যাবার সময় বলে গেছে রাতে গরম গরম পরোটা আর গরুর মাংস ভুনা করার জন্য। রান্না টা শায়েরী ভালোই করে।বাড়িতে যখন ছিলো তখন থেকেই মাকে সব কাজে সাহায্য করতে করতে শেখা হয়ে গেছে সবকিছু। মা মাঝে মাঝেই ওকে দিয়ে এটা ওটা রান্না করাতো।বলতো,শিখে রাখ,শ্বশুরবাড়িতে গেলে কেউ যেন না বলতে পারে মেয়ে কোন রান্নাই জানে না।
শ্বশুরবাড়িতে রান্না করতে হবে বলেই যে ও রান্না করতো তা নয়।নতুন নতুন রেসিপি শেখার জন্য ওর আগ্রহ ছিলো অনেক।নতুন সংসারে ওর শিখে রাখা গুলো কাজেই লেগেছে বলা যায়।নাবিল খুব খুশি ওর রান্না খেয়ে।মাঝে মাঝেই এটা সেটা খাওয়ার জন্য বায়না করে আর শায়েরী নিজের সবটুকু মনোযোগ আর ভালোবাসা দিয়ে নাবিলের জন্য তা রান্না করে।

খামির করা প্রায় শেষের দিকে এমন সময় কলিংবেল বাজল।শায়েরী আটাকে আরো তাড়াতাড়ি দলাই মলাই করার দিকে মনোযোগ দিলো।কে এলো এ সময়?নাবিল তো এতো তাড়াতাড়ি আসে না?প্রশ্নটা মনে রেখেই জোর হাতে কাজ শেষ করলো।এদিকে বেল বেজেই চলেছে। দরজার ওপাশের মানুষ টার যেন তরই সইছে না।
শায়েরী দ্রুতবেগে দরজা খুললো।যাকে দেখলো তাকে দেখার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলো না।নাবিলের মা দাঁড়িয়ে আছে।
নিজের আঁচল টাকে সামনে টেনে আনলো শায়েরী।অস্ফুটস্বরে সালাম জানালো।একপাশে সরে গিয়ে ভেতরে আসতে বললো নাবিলের মা শাহানা বেগমকে।

_________

“সংসার তো বেশ ভালোই সাজিয়েছো দেখছি।হবে বা নাই কেন?হাজার হোক নাবিল তো আর কোন ছোটখাটো চাকরি করে না।ওর এক মাসের বেতন দিয়ে তো তোমার বাপের বাড়ির সংসার চার মাস চলে যাবে।তাই না?”

শ্বাশুড়ির দাঁত চিবিয়ে বলা এমন কঠিন কথা গুলো হজম করতে বেশ কস্ট হচ্ছে শায়েরীর।এ কথার কি উত্তর দেবে ও?কে বলবে এই কিছুদিন আগে পর্যন্তও শায়েরী দিশার সাথে নাবিলদের বাড়িতে গেলে উনি মা মা বলে অস্থির হতেন।হরেকরকমের নাস্তার আয়োজন করে ফেলতেন মূহুর্তেই।মাঝে মাঝেই ওর মুখটা উঁচু করে ধরে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলতেন,দোয়া করিস ঠিক তোর মতো একটা মিস্টি মেয়েকে যেন নাবিলের বউ করে আনতে পারি।
আর আজ?সেই দিনের সাথে আজকের দিনের কি ভয়ানক তফাৎ।

ড্রয়িংরুমটাকে ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে আবারো বললেন,
“এই জন্য বুঝি আমাদের বাড়িতে যেতে?নাবিলকে পটানোর জন্য? চেষ্টা চালিয়েছিলে বড়লোকের ছেলেকে ফাঁদে ফেলার।সে কাজে তুমি পুরোপুরি সফল।বলতে হবে এলেম আছে তোমার।”

“আন্টি, প্লিজ,বিশ্বাস করুন উনার সাথে আমার কোন সম্পর্ক ছিলো না।আমি কখনোই চেষ্টা করিনি উনাকে আমার প্রেমের ফেলানোর।আর না উনাকে বিয়ে করতে বলেছিলাম।আমার বিয়ে তো ঠিকই ছিলো।”

“ঠিক ছিলো তো হলো না কেন?ওর সাথে পালিয়ে গেলে কেন?”

“আমি তো যেতে চাইনি।উনিই তো আমাকে জোর করেছে।মরে যাবে বলেছে।”

“ও মরে গেলে তোমার কি?যেতো মরে তাতে তোমার কি হতো?”

শায়েরী হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।

“তুমি অস্বীকার করতে পারো তুমি ওকে ভালোবাসো তাই ওর সাথে গিয়েছিলে?”

শায়েরী কিছু সময় চুপ রইলো।এরপর শান্ত অথচ দৃঢ় স্বরে বললো,
“না।আমি অস্বীকার করি না।কিন্তু এতে আমার দোষ টা কোথায়?কাউকে ভালোবাসা কি অপরাধ? ”

শাহানা বেগম তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন।কঠিন গলায় বললেন,
“মাটিতে থেকে আকাশের চাঁদ ছুতে চাওয়াটা অপরাধ।তেলে জলে কখনো মেশে না।এই কথাটা আশা করি নিশ্চয়ই শুনেছো।নাবিল চাইলেই তুমি সায় দিলে কেন?নিজের ব্যাকগ্রাউন্ড তো দেখবে।তোমার পারিবারিক অবস্থা আর নাবিলের পারিবারিক অবস্থার মধ্যে যে বিস্তর ফারাক আছে তা তো তুমি অবশ্যই জানো।এই ফারাক টাই না একসময় তোমাদের সম্পর্কের মধ্যেও ঢুকে যায়।”
টি টেবিলে রাখা পানির জগ থেকে পানি ঢেলে ঢকঢক করে গিলে নিলেন শাহানা বেগম।এরপর আবার শুরু করলেন।
“আবার তোমার বাবা কি করেছে নিশ্চয়ই শুনেছো।নাবিলের বাবাকে যা নয় তা বলে অপমান করেছেন।বলে কিনা নাবিল না কি তোমাকে তুলে নিয়ে গেছে।নাবিলের বাবা কি এসব ভুলে যাবেন?কখনোই না।নাবিলের বাবাকে তুমি চেনো না।উনি একবার যখন তোমাকে মেনে নেননি তার মানে কখনোই নেবেন না।আর এর মানে যে উনি উনার ছেলেকেও পরিত্যাগ করেছেন তা কিন্তু নয়।নাবিল আমাদের একমাত্র সন্তান।নাবিলকে ফিরে পাবার জন্য উনি অনেক কিছুই করতে পারেন।বিয়ে করেছো,সংসার পেতেছো তার মানে এই নয়, যা আজ তোমার কাছে আছে তা কালও থাকবে।সব কিছুরই তো শেষ আছে।”

_______

বেশ কিছু সময় কলিংবেল বাজানোর পরও দরজাটা খুললো না দেখে নাবিল ভাবলো শায়েরী হয়তো বাইরে বেরিয়েছে কোন প্রয়োজনে।এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো।হাতের ব্যাগটা সোফার উপর রেখে শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে বেডরুমে গেলো।লাগোয়া বাথরুমের পানির আওয়াজ পেতেই বুঝলো শায়েরী ঘরেই আছে। হয়তো শাওয়ার নিচ্ছে।
শার্ট টা খুলে হ্যাঙগারে রেখে দিলো।দরজায় হালকা টোকা দিয়ে দুস্টুমির স্বরে বললো,

“শায়েরী, দরজাটা খুলে দাও।আমিও আসি।তাহলে সময় নস্ট কম হবে। ”

কলিংবেলের আওয়াজ শুনেই শায়েরী বুঝতে পেরেছিল নাবিল এসেছে।আয়নাতে তাকাতেই বুঝতে পারলো ওর চেহারার হাল বেহাল হয়ে গেছে। খুব বেশি কান্নাকাটি করার কারনে চোখমুখ ফুলে আছে।নাবিল দেখলেই কিছু আন্দাজ করতে পারবে।তাই ঝটপট বুদ্ধিতে যা এসেছে তাই করেছে।শাওয়ারে ঢুকে গেছে।নাবিলকে ওর মায়ের ব্যাপারটা জানাতে চায় না শায়েরী।হতেও পারে ছেলের কর্মকান্ডে দুঃখ পেয়ে এসব বলে গেছেন।পরে হয়তো ঠিক হয়ে যাবে সবকিছু।
নাবিলের গলার আওয়াজ পেয়ে একটু হাসলো শায়েরী।ইদানিং ওর সাথে নাবিলের সম্পর্কটা একদম সহজ হয়ে গেছে।
“একদম না।আমার হয়ে গেছে। ”
উত্তর করলো শায়েরী।

শায়েরী বের হয়ে এলে নাবিল ফ্রেশ হতে চলে যায়।শায়েরী চলে আসে রান্নাঘরে।গরুর মাংসটা আগেই রান্না করে রেখেছিলো।দ্রুতহাতে পরোটা বানিয়ে টেবিল সাজালো শায়েরী।ততক্ষণে নাবিলও হাজির।

_______

ঘুমুনোর আগে এক কাপ চা না হলে চলে না নাবিলের।এটা বহু আগে থেকেই অভ্যাস ওর।বেডরুমের সাথে লাগোয়া বারান্দায় বসে আছে নাবিল।বারান্দা টা নানারকম ফুলগাছে ভরা।শায়েরীর খুব শখ ফুল গাছ লাগানোর।গত চারমাসেই ও নানারকম ফুল গাছের মেলা বসিয়ে দিয়েছে এখানে।সেই সাথে রেখেছে দুটো বেতের চেয়ার একটা ছোট্ট টি টেবিল।অবসরে এখানে বসে বই পড়ে শায়েরী।আর যখন নাবিল বাসায় থাকে দুজন মিলে এখানে চা খায় আর আড্ডা দেয়।

“এ্যাই নাও তোমার চা।”

চায়ের কাপটা নিয়ে তাতে ছোট করে চুমুক দিলো নাবিল।শায়েরী পাশের চেয়ারটায় বসলো।
চা টা শেষ করে শায়েরীর মুখোমুখি বসলো নাবিল।ওর দু হাত নিজের হাতে নিয়ে বললো,

“কি হয়েছিলো তোমার?এতো কেঁদেছিলে কেন?”

শায়েরী অপ্রস্তুত হয়ে পরলো কিছুটা। তবুও জোর গলায় বললো,

“কোথায় এতো কেঁদেছিলাম?”

“যখন গোসল করছিলে তার আগে।”

“ধুরর্।কি যে বলো না।আমি কাঁদব কেন?”

“তাহলে চোখ মুখ এমনিতেই ফোলা ছিলো?চোখ দুটোও তো লাল ছিলো ভীষণ। না কাঁদলে কারো চেহারা এমন হয় না।”

শায়েরী চুপ করে রইলো।তখনকার কথা মনে করে দু চোখ জলে ভরে গেলো। শায়েরীকে এমন নিচু হয়ে থাকতে দেখে ওর মুখটা উঁচু করে তুলে ধরলো নাবিল।দু চোখের জল দেখে তা মুছে দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো শায়েরীকে।অস্থির গলায় জিজ্ঞেস করলো,

“কি হয়েছে শায়েরী? এখনো কাঁদছো?প্লিজ বলো আমাকে।কেউ কিছু বলেছে?”

শায়েরী মাথা নাড়লো।

“তাহলে?”

“এমনি।”
জড়ানো গলায় উত্তর দিলো শায়েরী।

“এমনি এমনি কেউ এতো কাঁদে?সত্যি করে বলো না হলে আমি কিন্তু খুব রাগ করবো।”

“বললাম তো এমনি।”

“তুমি বলবে?”

শায়েরী নাবিলের বুক থেকে মাথা তুলে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো,
“একটা কথার সত্যি জবাব দিবে?”

“কি?”

“তুমি কি আমাকে সত্যিই ভালোবাসো?”

“কোন সন্দেহ? ”

“বলো না।”

“খুব ভালোবাসি।এখন যদি জিজ্ঞেস করো কতোটা,তা বলতে পারবো না।শুধু এতটুকু জানি তোমাকে ছাড়া আমি আমাকে ভাবতেও পারি না।”

“কখনো আমাকে ছেড়ে যাবে না তো?”

নাবিল হো হো করে হেসে উঠে ওকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
“কি বলছো এসব?ছেড়ে যাবো কেন?”

“হাসবে না।যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দাও।”
রেগে গিয়ে বললো শায়েরী।

“না, যাবো না।কখনো না।কোনদিনও না।”
আবেগমাখা গলায় বললো নাবিল।

শায়েরী নাবিলকে জড়িয়ে ধরে বললো,

“আমাকে ছেড়ে কখনো যেও না কিন্তু। আমি তোমাকে খুব খুব খুব ভালোবাসি।সব ছেড়ে আমি তোমার কাছে এসেছি।তুমি যদি আমাকে ছেড়ে চলে যাও আমি বাঁচবো না নাবিল।আমি মরে যাবো।একদম মরে যাবো।”

নাবিল একহাতে শায়েরীর মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করলো।ওর চোখের পানিতে নাবিলের কাঁধ ভিজে যাচ্ছে। ওকে এমন আকুল হয়ে কাঁদতে দেখে নাবিলের চোখেও জল।

শায়েরীর মুখ টা দুহাতে তুলে ওর কপালে খুব গাঁঢ় করে চুমু একে দিয়ে বললো,

“আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি শায়ু।তোমাকে ছেড়ে বেঁচে থাকা আমার জন্যও অসম্ভব। এমন করে কেঁদো না।মৃত্যু ছাড়া আর কোনকিছু আমাদের আলাদা করতে পারবে না।আই প্রমিস।বিলিভ মি।”

নাবিলের একথায় আলতো করে হাসলো শায়েরী।ফের দুহাতে নাবিলের গলা জড়িয়ে ওর বুকে আশ্রয় নিলো।

চলবে…….

মুনিরা মেহজাবিন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here