মেঘের পরে মেঘ-৮

মেঘের পরে মেঘ -৮

“এ্যাই নাবিল, শুনেছিস নাকি?তানজুর হাসবেন্ড না কি মারা গেছে?”
বললো তুষার।

“কে বললো তোকে?”
উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করলো নাবিল।

“আসার সময় শুনলাম।তানজুর হাসবেন্ড এর খালাতো ভাই তো আমার ক্লাসমেট ছিলো।অফিসে আসার সময় ওর সাথে দেখা।তখনই বললো আর কি।”

“কবে হলো এসব?কোন অসুখ করেছিলো না কি?”

“না রে।সুস্থ মানুষ। রোড এক্সিডেন্টে সব শেষ। বাইক নিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিল প্রতিদিনের মতো।ট্রাক দিয়েছে এক ধাক্কা। ”

“আহা রে।তানজুর তো মনে হয় একটাই বাচ্চা?বাচ্চা টাও তো মনে হয় খুব ছোট?”

“হ্যাঁ রে।মাত্র আট মাস বয়স।”

“খুব খারাপ লাগছে রে ওর কথা টা শুনে।একসাথে এতোদিন কাজ করেছি, ভালোই ছিলো মেয়েটা।কিন্তু? নসিব।সবই নসিব।আল্লাহ যে কার কপালে কি লিখে রেখেছেন তা উনিই ভালো জানেন।”
আফসোসের সুরে বললো নাবিল।

“যাবি নাকি একবার ওর বাসায়?”
উৎসাহ নিয়ে বললো তুষার।

নাবিল চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,
“আমি তো ওদের বাসা চিনি না।”

“আমি চিনি।যাবি নাকি? ”

“অফিস শেষে যাবো না হয়।”

“আচ্ছা। সেই কথাই রইলো।”
বলেই উঠলো তুষার।তুষারের যাত্রাপথে খানিকটা সময় চেয়ে রইলো নাবিল।একই অফিসে কাজ করার সুবাদে বেশ বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক দুজনের মধ্যে। তুষার যেন নাবিলের একজন বড়ভাই।

_______

শায়েরী বাংলাবাজার এসেছে বই কেনার জন্য। অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্রী ও।মাস দুয়েক পরেই ওর ফাইনাল পরীক্ষা। অথচ পাঠ্যবইয়ের সাথে যোগাযোগ নেই বললেই চলে।গতকাল রাতে নাবিল খুব রাগ করেছে পড়াশোনার ব্যাপারটা নিয়ে। ও চায় শায়েরী অনার্সটা বেশ ভালোভাবে কমপ্লিট করুক।
কিন্তু শায়েরীর যেন এ ব্যাপারে আগ্রহ নেই বললেই চলে।সংসার নিয়েই ব্যস্ত সে।পড়াশোনার চেয়ে সংসার বেশি গুরুত্বপূর্ণ এ কথাটা নাবিলকে বোঝাতে গিয়ে খুব হ্যানস্তা হয়েছে। নাবিলের রক্তচক্ষু দেখে কথা আর আগাতে সাহস করেনি।
মিনমিন করে বলেছে,আজই ও সমস্ত বইপত্র কিনে পড়া শুরু করে দেবে।সেই কথার প্রেক্ষিতেই এখানে আসা।কয়েকটা দোকান ঘুরতেই বইগুলো পেয়ে গেলো।
বই কেনার পরও বেশ কিছু টাকা বেঁচে যাওয়ায় ও একটা রিকশা নিয়ে সোজা বঙ্গ মার্কেট চলে গেলো।সেখানে ঘুরে ঘুরে নাবিলের জন্য দুটো টি শার্ট,একটা বিছানার চাদর,নিজের জন্য এক জোড়া জুতো কিনে বাসায় ফেরত আসার সময় হঠাৎই ওর মা খাদিজা বেগম সামনে এসে পরে গেলো।
মা,মেয়ে কিছু সময় হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো।দীর্ঘ আট মাস মাকে দেখছে শায়েরী।আগের থেকে রোগা হয়েছেন।কিছুটা কালোও লাগছে দেখতে।ও এগিয়ে গেলো মায়ের দিকে।দুহাতে মাকে জড়িয়ে ধরে বললো,

“কেমন আছো মা?”

খাদিজা বেগম কোন কথা বললেন না।দুহাতে শায়েরীর হাত দুটোকে সরিয়ে দিলেন।কঠিন গলায় বললেন,

“কে আপনি?আপনাকে তো চিনতে পারছি না?”

শায়েরী অবাক দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকালো।মায়ের রাগকে ও জানে।মা ওকে বকুক, মারুক। কিন্তু তা না করে একেবারে চিনতেই অস্বীকার করে দিলো।মনে মনে ভেঙে গুড়িয়ে গেলেও আবার এগিয়ে আসলো শায়েরী।
“ভুল করেছি মা।অন্যায় করেছি।তাই বলে এভাবে বলো না মা।নিজের মেয়েকে অস্বীকার করো না মা।প্লিজ। ”

“কে নিজের মেয়ে?আপনি ভুল করছেন।আমার কোন মেয়ে নেই।আমার দুটো ছেলে।”

“মা এভাবে বলো না মা।”

“তো কিভাবে বলবো?যেদিন আপনি আপনার পছন্দের মানুষকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন, সেদিন থেকে আপনি আমাদের জন্য মৃত।এটা শুধু আমার কথা না,আমার স্বামীরও কথা।”

“বাবা বলেছেন একথা?”

“হ্যাঁ।”

“বাবা বললো বলেই আমি তোমার পর হয়ে গেলাম মা?”

“অবশ্যই।আপনি যদি দুদিনের ভালোবাসার এক ছেলের জন্য আপনার পরিবারের কথা না ভেবে তার এক কথায় তার হাত চলে যেতে পারেন,সেই ছেলেই যদি আপনার কাছে বড় হয়,তবে আমার কাছেও আমার স্বামী বড়।তার কথা বড়।তার ইচ্ছে বড়।আজকের পর থেকে আপনার সাথে যদি আমার ধাক্কাও লাগে তবুও আপনি আমার কথা বলতে এগিয়ে আসবেন না।আপনার সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই।আশা করি আপনি আমার কথাগুলো বুঝতে পেরেছেন।এখন সামনে থেকে সরুন।আজ আমার স্বামীর ছুটির দিন।আমার অনেক কাজ।সরুন।”

শায়েরী ব্রজাহতের মতো একপাশে সরে গেলো।খাদিজা বেগম দ্রুত চলে গেলেন সেখান থেকে।হতভম্বের মতো কিছুক্ষন সেভাবেই দাঁড়িয়ে থেকে ধীরে ধীরে বাড়ি ফিরলো।

________

বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে শায়েরী।থেকে থেকেই বিকেলের কথাগুলো মনে পরছে।এক নাবিলের জন্য আজ সবার কাছে ও দোষী। এতোসব কটুবাক্যের মধ্যে একটাই শান্তি। সেটাও নাবিল।ও পাশে থাকলে সব কস্টগুলোকে নিমিষেই ভুলে যায় শায়েরী।যখনই মন খারাপ হয় তখনই নাবিলের কথা মনে হয়।ইসস্ ও যদি এখন পাশে থাকতো তাহলে একটু ভালো লাগতো, এমন টাই মনে হতে থাকে।
এখনো তাই মনে হচ্ছে। এমনিতে রাত আটটার মধ্যে নাবিল এসে যায়।কিন্তু আজ?আজ এতো দেরি হচ্ছে কেন কে জানে?
প্রতিদিনের মতে আজও যাওয়ার আগে রাতে কি খাবে তা বলে গেছে।বলেছে আজ তাড়াতাড়ি চলে আসবে।আর আজই কিনা এই অবস্থা। নাবিলের ফরমায়েশ মতো শায়েরী আজ কুচো চিংড়ি দিয়ে করলা ভাজি করেছে,ইলিশ মাছের দোপিয়াজি আর শোল মাছের ভর্তা।এদিকে দশটা বাজে জনাবের কোন খবর নেই।
এতসব কথা ভাবতে ভাবতেই বাড়ির সামনে একটা রিকশা থেকে নাবিল নামলো।ওকে দেখে মনটা শান্ত হলো শায়েরীর।
রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দিলো নাবিল।বালিশে মাথা দিয়ে শায়েরী জিজ্ঞেস করলো,
“আজ এতো দেরি হলো যে?”

“আর বলো না।একটা জায়গায় গিয়েছিলাম।”

“কোথায়?”

“আমাদের এক পুরোনো কলিগের হাসবেন্ড মারা গেছে গত পরশু।আজ জানলাম একথা।অফিস শেষে তুষার আর আমি দুজনে ওর বাড়িতে গিয়েছিলাম।তাই আসতে দেরি হলো।”

“আহা রে।বাচ্চা কাচ্চা আছে নাকি?”

“হ্যাঁ।আট মাসের একটা ছেলে আছে।কি যে একটা অবস্থা তুমি না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবেনা।তানজু খুব ভেঙে পরেছে।”

“পরবেই তো।”

“তেমন কোন সেভিংস নেই বোধহয়।তানজু যে কিভাবে কি করবে?”

“আমাকে একদিন নিয়ে যাবে উনার ওখানে? ”

“কেন নয়?অবশ্যই নিয়ে যাবো একদিন।তানজু যে কি মিস্টি একটা মেয়ে আর ওর কপালটা দেখো।বেচারি।”

“সবই আল্লাহর ইচ্ছা। আমরা কি করতে পারি বলো?”

শায়েরীর কথায় একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লো নাবিল।

চলবে……

মুনিরা মেহজাবিন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here