প্রেম পর্ব -১৬

প্রেম 💚 (Love has no limits)

#পর্বঃ ১৬

সবাই এদিক সেদিক ঘুরাঘুরি করছে, গল্প করছে। কিন্তু স্পর্শিয়া যেন সবার সাথে থেকেও সাথে নেই৷ এইমুহূর্তে ও আরাধ্যর মিসিং প্রচন্ডভাবে অনুভব করছে। আরাধ্য ওর সাথে না থেকে যদি আশেপাশে থাকতো তবুও হয়তো শান্তি লাগতো। এখন যেন কেমন একটা অনুভূতি হচ্ছে মনের মধ্যে, এই অনুভুতির সাথে ও পরিচিত নয়। নজর গেল নিজের হাতে। গাঢ় রং ধারণ করেছে মেহেদী। পুরো সংসার একে দিয়েছে আরাধ্য ওর হাতের মধ্যে । আনমনেই হেসে দিল। প্রচলিত একটা কথা আছে, যার হাতের মেহেদীর রং যত গাঢ় হয়, তার হাজবেন্ড তাকে তত বেশি ভালোবাসে। কথাটা মনে পড়তেই স্পর্শিয়ার লজ্জা লাগলো। জোড়েই বলে ফেললো,
– তারমানে আরাধ্য আমাকে অনেক ভালবাসে।
– হ্যা, জীবনের চাইতেও বেশি ভালবাসি।
স্পর্শিয়া চমকে গিয়ে পাশে তাকাতেই দেখে আরাধ্য বসে আছে। এটা কি করে সম্ভব? ও কি করে এল এখানে? ওর কথা ভাবতে ভাবতে আবার খোলা চোখে স্বপ্ন দেখছে না তো ও।
– স্পর্শ, তোমার পাশেই আছি আমি৷ আর আমি স্বপ্ন না, সত্যি।
স্পর্শিয়া এবার আশেপাশে নজড় দিল। বেশিরভাগ মেয়েরাই আরাধ্যর দিকে তাকিয়ে আছে। তারমানে সত্যিই আরাধ্য এখানে আছে। এটা ও আগেও খেয়াল করেছে আরাধ্যর আশেপাশে মেয়েরা থাকলে সবাই ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।

– কিন্তু তুমি কি করে এলে এখানে?
– আমাকে কি তোমার লুলা মনে হয়? পায়ে হেটে, আর রিক্সায় চড়ে এসেছি, আবার কি করে আসবো?
– আরে ধুর। সেটা না। তুমি তো বাসায় ছিলে। তবে এখানে কেন?
– আমার পিচ্চি বউকে দেখতে এসেছি৷
– সবাই কি ভাববে! এমনিতেই তোমাকে কত কিছু বলে সবাই, আর এখন তো…
স্পর্শিয়ার কথার মাঝেই পুরো গার্লস গ্রুপ এসে হাজির।
– ওওওও! আচ্ছা! এই চলছে তবে! আরাধ্য, তুই এখানে কি করিস?
– তোরা তো এমনিতেই ডাইনী। আরও সেজে এসেছিস পেত্নী। তোদের এই পেত্নী রুপ দেখে রাস্তায় কোন মানুষ আবার মরে টরে গেল নাকি, তা দেখার জন্যই এসেছি৷
– এ্যাই..এ্যাই.. কি বলিস? আমরা পেত্নী, হুম? আমরা পেত্নী?
– হুম অবশ্যই তোরা পেত্নী। বাসা থেকে বের হওয়ার আগে নিজের চেহারাটা তো অন্তত দেখে বের হতি, তাহলে তোরা নিজেরাই ভয় পেয়ে যাতি।
– দাড়া। তোর খবর আছে আজকে। লুকিয়ে লুকিয়ে বউয়ের কাছে আসা তাই না? এখনি খবর দিচ্ছি ফুপিমণিকে। দাড়া।
– লাভ নেই ভুতনির দল। ড্যাড আমাকে এখানে পাঠিয়েছে, তোদের মতো ভুতনিদের বাসায় নেওয়ার জন্য। তোরা এত রাতে বাসায় যাওয়ার সময় আবার কোন দিক দিয়ে কার ঘাড় মটকে দিস, তখন তো আবার আমাদের বাড়ির বদনাম হবে। তাই পাঠিয়েছে তোদের নিতে।

ওদের এই খুনসুটি, ঝগড়া চলতেই থাকলো । আর স্পর্শিয়া ওদের কান্ড দেখে হাসতে হাসতে শেষ। এত বড় হয়ে গেছে সবাই, কিন্তু তবুও একজন আরেকজনের পেছনে এমনভাবে লেগে থাকে যেন ক্লাস টু / থ্রি তে পড়া বাচ্চা ওরা।
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
আরাধ্যকে খুজকে খুজতে প্যান্ডেলের প্রায় শেষের দিকে চলে এল স্পর্শিয়া। ও সবার সাথে বসে গল্প করছিল, এরই মধ্যে আরাধ্য কোথায় চলে গেল দেখলই না।
– আরাধ্য তুমি এই চিপার মধ্যে বসে আছ কেন? সবাই তো ওইদিকে।
– আমি লাজুক মশাদের অনুভব করার জন্য বসে আছি এখানে ।
– লাজুক মশা! মানে?
– এই যে দেখছ, আমার আশেপাশে কতগুলো মশা উড়ছে, কিন্তু আমার শরীরে বসছে না দেখছ?
– হ্যা, তো?
– এগুলো হচ্ছে লাজুক মশা৷ আমার শরীরে বসতে লজ্জা পাচ্ছে। এত সুন্দর একটা পরপুরুষের শরীর টাচ করতে লজ্জা তো পাবেই৷
– কি বলছ না বলছ৷ পাগল হয়ে গিয়েছ তুমি ৷ গাধা একটা।
– গাধা? আমি গাধা? নো বেবি৷ আম সো ইন্টেলিজেন্ট।
– আমার ঘোড়ার ইন্টেলিজেন্ট তুমি।
– কেন তোমার বিশ্বাস হয় না?
– না, কখনোই না ৷ তুমি গাধা বলেই আমার মতো একটা ইন্টেলিজেন্ট মেয়ে পেয়েছ।
আরাধ্য হাহাহা করে হেসে বলল,
– তুমি ইন্টেলিজেন্ট! তুমি? আমি তো একটা সহজ প্রশ্ন করেই তোমাকে আটকিয়ে দিতে পারব।
– পারলে আটকাও দেখি।
– আচ্ছা, তবে উত্তর দাও। একটা গাছে দুটো পাখি আছে৷ একটার নাম আই হেইট ইউ, আরেকটার নাম আই লাভ ইউ। পাখি দুটোর মধ্যে ঝগড়া হলো। ঝগড়া করে আই হেইট ইউ উড়ে চলে গেল। তাহলে গাছে কোন পাখিটা রইলো?
– এটা তো খুব ইজি এন্সার৷ আই লা…
অর্ধেক বলেই স্পর্শিয়া থেমে গেল। সাথে সাথে দুই হাতে মুখ চেপে ধরলো। হায় আল্লাহ। কি বলতে নিচ্ছিল ও!
আরাধ্য হাসতে হাসতে শেষ।
– কি? বলেছিলাম না, তুমি এন্সার দিতে পারবে না।
– চুপ। আমি কেন, এটার এন্সার কোন মেয়ে ই দিতে পারবে না ।
– ওকে, লেটস সি৷
একটু দূরেই সিলভিয়া অন্য বাচ্চাদের সাথে খেলছিল। আরাধ্য সিলভিয়াকে ডাক দিতেই ও চলে এল।
– হ্যা চাচ্চু বলো।
সেম প্রশ্নটা আরাধ্য সিলভিয়াকেও করলো।
– এবার বল তো বাবা, গাছে কোন পাখিটা আছে এখন?
– আই লাভ ইউ।
– এই তো ভেরি গুড৷ যাও বাবা, খেলতে যাও৷
– আচ্ছা৷
এবার আরাধ্য স্পর্শিয়ার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলল,
– দেখলে তো, বাচ্চা মেয়েটাও তোমার থেকে কত ইন্টেলিজেন্ট।
– আমি তোমাকে বলেছি কোন মেয়ে এর এন্সার দিতে পারবে না।
– তবে আমাদের সিলভিয়া কি মেয়ে ছিল না?
– মেয়ে মানে বড় কোন মেয়ের কথা বলেছি। এ্যাডাল্ট মেয়ে৷
– তুমি তো এ্যাডাল্ট না।
– ধুর! বেশি কথা বল।

পেছন থেকে কেও একজন বলে উঠলো,
– আমি তো এ্যাডাল্ট, কিন্তু আমি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো।

স্পর্শিয়া পিছনে ঘুরতেই দেখলো ফর্সা, চিকন চাকন, শাড়ি পড়া একটা মেয়ে। আরাধ্য বেশ খুশি হয়েই বলল,
– আরে, ঝিনুক। কেমন আছেন?
– হুম ভালো। আপনি?
-হ্যা, ভালো।
– তো, কি নিয়ে যেন কথা হচ্ছিল? প্রশ্নের উত্তর টা তো আমি দিতে পারবো।
আরাধ্য খেয়াল করলো স্পর্শিয়া ঝিনুকের কথা শুনে ওর দিকে তাকাচ্ছে আর রাগে বারবার নাক ফুলাচ্ছে। স্পর্শিয়াকে জেলাস করার জন্য ইচ্ছে করেই বলল,
– হ্যা, হ্যা, বলুন না। উত্তর টা বলুন। স্পর্শিয়াকে কতক্ষন যাবত বুঝাচ্ছি, কিন্তু ও তর্ক করেই যাচ্ছে আমার সাথে।
– আই লাভ ইউ।
ঝিনুকের কথা শুনে আরাধ্য আর স্পর্শিয়া দুজনেই হতভম্ব হয়ে গেল। আরাধ্য বুঝতে পারেনি ঝিনুক সত্যি সত্যি এভাবে কথাটা বলে ফেলবে।
স্পর্শিয়া চেচিয়ে বলল,
– কি বললেন আপনি?
– আই লাভ ইউ বলেছি, উনি যে প্রশ্ন করেছিলেন তার এন্সার দিলাম জাস্ট।
স্পর্শিয়ার কান্না পাচ্ছে। পানি জমতে শুরু করেছে চোখের কোনে। নাহ, আর এক মূহুর্ত থাকা সম্ভব না। এখানে থাকলে চোখের পানি আটকে রাখতে পারবে না। খুব জোড়ে জোড়ে হেটে স্পর্শিয়া চলে গেল ওদের সামনে থেকে। স্পর্শিয়ার এভাবে চলে যাওয়াতে আরাধ্য খুব অবাক হলো। ও তো চাচ্ছিল স্পর্শিয়াকে একটু জেলাস ফিল করাতে, কিন্তু স্পর্শিয়া হয়তো খুব কষ্ট পেয়েছে। আরাধ্যও খুব বেশি সময় নষ্ট না করে স্পর্শিয়ার পেছন পেছন গেল। স্পর্শিয়া এরমধ্যেই লোকচক্ষুর আড়ালে এসে চোখের পানি মুছছে। কষ্ট হচ্ছে ওর খুব। কিসের কষ্ট তা ও নিজেও জানে না। আরাধ্য স্পর্শিয়ার পিছনে এসে দাঁড়ায়। ও বুঝে ফেললো স্পর্শিয়া কাদছে।

– স্পর্শ, তুমি কাদছো?
আরাধ্যর ভয়েস শুনে স্পর্শিয়া তাড়াহুড়া করে চোখের পানি মুছে ফেললো।
– তুমি কাদছ কেন সোনা? ওইটা জাস্ট একটা মজা ছিল। তোমাকে হার্ট করার কোন ইন্টেনশন আমার ছিল না, ট্রাস্ট মি। আর ঝিনুককে মজা করে বলেছিলাম, ও এভাবে এন্সার দিবে আমি বুঝতে পারিনি৷
স্পর্শিয়ার চোখ বেয়ে আবারও পানি পড়া শুরু হয়েছে। আরাধ্য স্পর্শিয়ার চোখের পানি মুছে দিল। নাক টানতে টানতে স্পর্শিয়া জিজ্ঞেস করল,
– ওই মেয়ে কে?
– আরবাব (যার বিয়েতে এসেছে) এর শালি। সম্পর্কে বেয়াইন হয় তাই একটু মজা করছিলাম।
– তোমার সাথে পরিচয় কি করে?
– ঢাকাতে দু বার দেখা হয়েছিল।
কথা শুনে স্পর্শিয়ার নাক টানার পরিমান আরও বেড়ে গেল। আরাধ্য ভয় পেয়ে বলল,
– জাস্ট দু বার ই দেখা হয়েছে। আর তেমন কোন কথা হয়নি৷
স্পর্শিয়ার গাল বেয়ে আবারও পানি পড়ছে। কান্না করতে করতে বলল,
– মেয়েরা তোমার সাথে এমন করে কেন? এভাবে তাকিয়ে থাকে কেন? আমার ভালো লাগে না এসব।
– আমি তো আর ওদের তাকিয়ে থাকতে বলিনা স্পর্শ।
– তবুও, ওরা তাকাবে কেন? কেও তোমার দিকে তাকাবে না। কেও না মানে কেও না।

একটু চুপ করে কি যেন ভেবে স্পর্শিয়া আবার বলা শুরু করলো,
– এ্যাই, তুমি বোরকা পড়বে এখন থেকে। আমি কিচ্ছু জানিনা তুমি বোরকা পড়বে।
আরাধ্য দুবার শুকনো ঢোক গিলে বলল,
– স্পর্শ, বোরকা তো মেয়েরা পড়ে।
– তুমিও পড়বে৷ আমি আর কিছু জানিনা। তুমি শুধু আমার, আর কারও না।
আরাধ্যর চোখ চিকচিক করে উঠলো।
– কি বললে স্পর্শ? আমি শুধু তোমার?
কি বলে ফেলেছে তা খেয়াল আসতেই স্পর্শিয়া এবার চুপ হয়ে গেল। কান্নাও থেমে গেল।
আরাধ্য কিছু না বলেই স্পর্শিয়াকে নিজের বাহুডোরে নিয়ে নিল। স্পর্শিয়ার কাছে মনে হচ্ছে এই জিনিসটারই হয়তো অপেক্ষায় ছিল ও এতক্ষন, তাই এত শান্তি লাগছে।

– স্পর্শ, চলো।
– কোথায়?
আরাধ্য স্পর্শিয়ার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ওকে হাত ধরে নিয়ে ঝিনুকের সামনে দাড়া করালো। স্পর্শিয়া এক নজর আরাধ্যর চোখের দিকে তাকাল। বুঝার চেষ্টা করলো আরাধ্যর উদ্দেশ্য কি, কেন এনেছে ওকে এখানে।
ঝিনুক আরাধ্যকে দেখে খুশি খুশি ফেস নিয়েই বলল,
– আরে আরাধ্য। আপনি এসেছেন? তখন তো খুব তাড়াহুড়ো করে চলে গেলেন।
– হ্যা, একটা কাজ ইনকমপ্লিট ছিল। তাই ফিরে আসতে হলো ।
– কি কাজ?
আরাধ্য স্পর্শিয়ার কাধে হাত রেখে ওকে নিজের কাছে টেনে বলল,
– মিট মাই ফিওন্সে, স্পর্শিয়া।
ঝিনুকের খুশি খুশি চেহারা মুহূর্তের মধ্যেই ফ্যাকাসে হয়ে গেল।
– আ.. আপনি এনগেইজড?
– ইয়েস। ভাবলাম স্পর্শিয়ার সাথে তো আপনার পরিচয় ই করালাম না, তাই ওকে নিয়ে আসতে গিয়েছিলাম।
ঝিনুক কি বলবে খুজে পাচ্ছে না। তারপর একটা মেকি হাসি দিয়ে বলল,
– খুব কিউট কাপল তো আপনারা।
– ইয়েস, ইউ কেন সে। বায় দা ওয়ে, আসি তবে এখন।
– হ্যা। সি ইউ৷

ঝিনুক আরাধ্যর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। আরাধ্যকে ওর ভালো লেগেছিল। ওর এ্যাটিটিউড, পার্সোনালিটি সবই ইউনিক। কিন্তু ছেলেটা এ্যানগেইজড সেটা ওর ধারনাও ছিল না।
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
মাথা ধরে আছে স্পর্শিয়ার। ঘুম আসছে না। সচরাচর টেনশনে না থাকলে এমন হয় না ওর। বেডে শোয়া মাত্রই ঘুমিয়ে পড়ে। অথচ আজ এতো টায়ার্ড হওয়ার পরেও ঘুম পাচ্ছে না। মেয়েরা সবাই ঘরে ঢুকেই যে যার মতো ঘুমিয়ে পড়েছে। স্পর্শিয়া শুয়ে শুয়ে ভাবছে ও কি আজকের ব্যাপারটাতে খুব বেশি রিয়্যাক্ট করে ফেললো? ও কি প্রয়োজনের তুলনায় খুব বেশি কনসার্ন দেখাচ্ছে না? আচ্ছা, খারাপই বা লাগে কেন আরাধ্যর দিকে মেয়েরা তাকালে, বা মেয়েরা ওর সাথে বেশি মিশলে?
স্পর্শিয়ার ফোনে মেসেজের টোন বেজে উঠল। এত রাতে কে মেসেজ দিল? ফোন হাতে নিয়ে দেখে আরাধ্যর মেসেজ।
– Ghumiye porecho ?
স্পর্শিয়ার রিপ্লাই, “na ”
কয়েক সেকেন্ড পরেই আবার আরাধ্যর মেসেজ “baire ashbe ki? ”
স্পর্শিয়া মেসেজের কোন উত্তর না দিয়ে বাইরে বের হলো । সাথে সাথে আরাধ্যও বের হলো। কোন কিছু না বলেই হাটা শুরু করলো ওরা দুজন, যেন প্রায়ই এমনটা করে থাকে ওরা, বহু পুরনো অভ্যাস।

– আচ্ছা, আজকাল তোমার ঘুম হয় না কেন স্পর্শ?
– গতকাল দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। কিন্তু আজ কেন ঘুম আসছে না বুঝতে পারছি না।
– ওহ, তাহলে গতকাল মন খারাপের কারন ছিল দুঃস্বপ্ন। এটা কোন ব্যাপার না। মাঝেমধ্যে মধ্যে এমন হয় ই।
স্পর্শিয়াকে চুপচাপ দেখে আরাধ্যই বলল,
– আমি শুনেছি প্রেমে পড়লে মানুষের ঘুম হয় না।
স্পর্শিয়া এবার হেসে দিল।
– আমাকে প্রেমে ফালানো এত সহজ না।
– তো, কি করে প্রেমে ফেলা যায় আপনাকে?
– সেই রাস্তা তো আপনার নিজেরই খুজে বের করতে হবে মি. চৌধুরী।
– আই থিংক আমি অলমোস্ট সাকসেস। জাস্ট একটু বাকি। তোমার কনফেশন টা।
– হুহ। সেটা কখনোই করবো না।
– দেট মিনস ইউ লাভ মি৷
– নেভার।
– এ কথাটা এট লিস্ট বলো না। এখন ভালো না বাসলেও শীঘ্রই বাসবে তা আমি জানি৷
– এত কনফিডেন্স?
– ইটস ওভার কনফিডেন্স বেবি।
– লাভ নেই।
– লেটস সি।

পুকুরের সামনে আসতেই স্পর্শিয়া বলল,
– আজকে হাটবো না। যদি এখানে বসাতে কোন রিস্ক না থাকে তবে এখানেই বসি।
– না। রিস্ক নেই। তবে ফজরের আজানের আগেই চলে যেতে হবে।
– আজান তো আরও দু ঘন্টা পরে। অনেক টাইম আছে।

ওরা দুজনেই বসে পড়লো পুকুরপাড়ে। এই গরমেও খুব ভাল্লাগছে এই জায়গাটাতে। শান্ত, ঠান্ডা, নিরিবিলি একটা পরিবেশ৷
– স্পর্শ।
– হুম।
– আমার কোলে মাথা রেখে শুবে প্লিজ?
স্পর্শিয়া আরাধ্যর দিকে একবার নজর দিল। চাদের আলোতে ওর নীল চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। ওর চোখে এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।
স্পর্শিয়া মৃদু হেসে আরাধ্যর কোলে মাথা রাখলো। আরাধ্যর মুখে হাসি ফুটে উঠলো, আর অন্তরে প্রশান্তি। ও ভাবেনি স্পর্শিয়া সত্যিই ওর কোলে শুবে।

স্পর্শিয়া শোয়া মাত্রই আরাধ্য ওর কপালে আলতো করে চুমু খেল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। বেশ ঘন, কালো, লম্বা চুল স্পর্শিয়ার। একটা স্মেল আসছে চুল থেকে। বেশ সুন্দর মিষ্টি একটা স্মেল, যা আরাধ্যর বরাবরই খুব পছন্দ। এমন জোৎস্না রাতে স্পর্শিয়া ওর কোলে শুয়ে আছে, আর ও গান গাইবে না তা কি হয়। আরাধ্য গান শুরু করলো আর স্পর্শিয়ার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।

যখন নিঝুম রাতে, সব কিছু চুপ
নিষ্প্রাণ নগরীতে ঝিঝিরাও ঘুম,
আমি চাঁদের আলো হয়ে তোমার কালো ঘরে
জেগে রই সারা নিশি
এতটা ভালবাসি॥

এতটা ভালবাসি।।

এ কি অপরূপ সুন্দর তার স্বপ্নের বর্ষা রাতে
আমি ভিজে ভিজে মরি মিছে মগ্ন প্রভাতে
দেখি ভিষণ অন্ধকার মাঝে আলো ছায়ায়
তার নূপুর বাজে
আমি যে ভেবে ভেবে শিহরিত…
আমি সূর্যের আলো হয়ে তোমার চলার পথে
ছায়া হয়ে তোমায় দেখি
এতটা ভালবাসি..

এতটা ভালবাসি।।

গান শেষ করে স্পর্শিয়ার দিকে তাকাতেই দেখে ও ঘুমিয়ে পড়েছে। হালকা বাতাসে চুলগুলো মুখের উপর দুলছে। আরাধ্য চুলগুলো সরিয়ে দিল। চাদের আলো এখন সরাসরি স্পর্শিয়ার মুখের উপর পড়েছে। মানুষ বলে চাঁদ নাকি সবচেয়ে সুন্দর জিনিস। এই মূহুর্তে ওর কাছে যা আছে তার চেয়ে সুন্দর জিনিস আর কিছু হয় নাকি। আরাধ্য একদৃষ্টিতে স্পর্শিয়ার দিকে তাকিয়েই আছে৷ ওর জীবনের সবচেয়ে দামী জিনিসটা এই মূহুর্তে ওর কাছে । স্পর্শিয়ার দিকে তাকিয়েই ও পার করে দিতে পারবে হাজারো রজনী। আর কিচ্ছু চাই না ওর, শুধু স্পর্শিয়া চাই।

আজানের শব্দ কানে আসতেই আরাধ্যর সেন্স এলো। এত জলদি আজান দিয়ে দিল। স্পর্শিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন এত সময় চলে গেল বুঝতেই পারলো না । এই মূহুর্তটা ও হাতছাড়া করতে চাচ্ছে না, আবার কেও চলে আসলেও সমস্যা হবে। নিজের ইচ্ছাকে মাটি চাপা দিয়ে স্পর্শিয়াকে কোলে তুলে নিয়ে বাসার দিকে পা বাড়ালো আরাধ্য ।
.
.
.
.
.
.
.
ঘুম ভাঙতেই স্পর্শিয়া মনে করার চেষ্টা করছে, ও তো রাতে আরাধ্যর সাথে ছিল। কখন, কি করে ঘুমিয়ে পড়লো? আর এখানে এলই বা কি করে? ধুর। কিচ্ছু মনে পড়ছে না। কিছু মনে করার চেষ্টা করার পরেও মনে না পড়লে খুব রাগ লাগে। পাশ থেকে পায়েল আর সিমি মিলে ওকে দেখে হাসছে আর খুসফুস করছে। স্পর্শিয়া একবার আড়চোখে তাকালো। ওরা এমন করছে কেন বুঝতে পারছে না। না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেলল,
– ভাবি তোমরা এমন করছ কেন?
– আর বলো না তুমি। বুড়ো হয়ে গিয়েছি, তাই জামাই আর আগের মতো আদরও করে না, রোমান্টিকতাও নেই।
স্পর্শিয়া কথার আগা মাথা কিছুই না বুঝে ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে রইলো।
সিমি বলল,
– স্পর্শিয়া, জামাই তো পেয়েছ একটা বেশ রোমান্টিক। কত্ত ভালোবাসে তোমাকে।
স্পর্শিয়া এবার ঢোক গিলল। ওরা কি বলতে চাচ্ছে তা ও হয়তো আচ করতে পারছে।
– তারপর, কাল রাতে কি কি রোমান্স হলো আমার দেবরের সাথে? বলো, আমরাও একটু শুনি। (পায়েল)
– না..ভা…ভাবি। তেমন কিছু না। ঘুম আসছিল না, তাই একটু হাটতে বের হয়েছিলাম। হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কখন যেন। এখানে কি করে এলাম বুঝলাম না।
– আমার দেবর কি তোমাকে কোলে নিয়ে হাটছিল নাকি যে ঘুমিয়ে পড়েছিলে?
– না। এমন কিছু না। পুকুর পাড়ে বসে গল্প করছিলাম। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়লাম মনে নেই।
সিমি পায়েলকে বললো,
– আরে ভাবি। এসব কি যে বলছ। আসল কথা বলো না। স্পর্শিয়া তুমি জান রাতে কি হয়েছে?
স্পর্শিয়া ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো,
– কি হয়েছে?
– আরাধ্য তোমাকে কোলে নিয়ে হিরোর মতো রুমে এন্ট্রি নিয়েছে। উফফফফ। হোয়াট আ রোমান্টিক মোমেন্ট ইট ওয়াজ! বিছানায় তোমাকে শুইয়ে দিয়ে তোমার পাশেই হাটু গেড়ে বসে পড়ে। তোমার মাথায় হাত বুলাচ্ছিল, কপালে চুমু দিচ্ছিল, তোমার দুই হাত চুমুতে ভরিয়ে ফেলেছে। তারপর আবার একদৃষ্টিতে তোমার দিকে অনেকক্ষণ যাবত তাকিয়েই ছিল। হয়তো আমরা ছিলাম বলে, নয়তো মনে হয় ওর কবজা থেকে তোমার ঠোটটাও বাদ পড়তো না।
স্পর্শিয়া বেশ লজ্জা পেয়ে গেল ওদের কথায়। কি করেছে আরাধ্য এসব। ছিঃ ছিঃ। কেমন কান্ডজ্ঞানহীন ছেলে।
– আরে স্পর্শিয়া, এভাবে লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছ কেন? আমরাই তো। টেনশন করো না। এ কথা কাওকে জানাবো না আমরা।
বলেই ওরা দুজন ইচ্ছেমতো হাসা শুরু করলো।
– আমরা কিন্তু খুব বিনোদন পেয়েছি তোমাদের রোমান্স দেখে।
স্পর্শিয়া মিনমিনিয়ে বলল,
– আমিতো ঘুমিয়ে ছিলাম।
– এটাই তো বেশি ইন্টারেস্টিং ছিল যে তুমি ঘুমিয়ে ছিল। আর আমরা দুজন তো সেই মজা নিয়েছি। অনেকক্ষণ পার হয়ে যাওয়ার পরেও যখন আরাধ্য যাচ্ছিল না, ভাবি তখন শোয়া থেকে উঠেই সে কি যে বকা। বিশ্বাস করবে না, ওর চেহারা দেখার মতো ছিল৷ ও তো চিন্তাও করেনি যে আমরা জেগে ছিলাম। মূহুর্তের মধ্যেই ও দৌড়।

নাহ। স্পর্শিয়ার পক্ষে সম্ভব না এখানে থাকা। লজ্জায় ফ্রেশ হওয়ার অজুহাত দেখিয়ে তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে গেল ঘর থেকে।

ফ্রেশ হয়ে উঠানে এসে বসতেই আরাধ্যর আম্মু স্পর্শিয়াকে বলেন,
– মা, তুমি একটু আরাধ্যকে ডেকে তুলে দাও তো ঘুম থেকে। আমি বেশ কয়েকবার গিয়েছিলাম, কিন্তু ও উঠছে না। তোমার কথা শুনবে। যাও।
স্পর্শিয়া ভাবতে লাগলো, ভালই হলো। এখন আরাধ্যকে টেনে ঘুম থেকে তুলে উচিত শিক্ষা দিবে। কাল রাতে করেছে টা কি! সব মান ইজ্জত শেষ। এখন ওর খবর আছে।

স্পর্শিয়া রুমে ঢুকে আরাধ্যকে পেল না। গেল টা কই? ঘুমিয়ে থাকলে তো ভালই হতো। ঘুম থেকে টেনে তুলে নিচে ফেলে দিত। একদম উচিত শাস্তি হতো।
রুম টা বেশ বড়, আর খুব সুন্দর। বাহির থেকে দেখে মনে হয় না এই রুমটা ভেতরে এত সুন্দর। পুরো রুমে এ্যান্টিকের জিনিস রাখা। স্পর্শিয়া ঘুরে ঘুরে রুম টা দেখতে লাগলো। কিছুর আওয়াজ পেতেই পিছনে তাকিয়ে দেখে আরাধ্য। স্পর্শিয়া জমে যায়। খালি গায়ে, থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পড়ে আরাধ্য টাওয়াল দিয়ে চুল মুছছে। আরাধ্যর মুখের সামনে টাওয়ালের কিছু অংশ পড়ে থাকায় ও এখনো স্পর্শিয়াকে দেখতে পায়নি। আরাধ্যর সুঠাম জিম করা শরীরে বিন্দু বিন্দু পানি জমে আছে। একটা বিন্দু গড়িয়ে গড়িয়ে আরেকটা বিন্দুর সাথে জোড়া লাগছে। পায়ের পশম পানিতে ভিজে লেপ্টে আছে। স্পর্শিয়া আরাধ্যর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়েই আছে। ও ইচ্ছে করেও পারছে না আরাধ্যর উপর থেকে নজড় সরাতে। মনে হচ্ছে চোখ সরালেই কি যেন মিস করে ফেলবে। আরাধ্য তো যেকোন মেয়ের স্বপ্নের পুরুষ। সেই স্বপ্নের পুরুষকে এভাবে দেখে চোখ সরাতে ইচ্ছেই বা কার করবে। আরাধ্যর বুক, পিঠ, পুরুষালী গঠন সব যেন স্পর্শিয়াকে ওর দিকে আকৃষ্ট করছে৷

চুল মুছে টাওয়াল বিছানায় ফেলতেই আরাধ্য স্পর্শিয়াকে দেখে অবাক হয়ে গেল। দুজনের চোখাচোখি হতেই স্পর্শিয়া সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিল। স্পর্শিয়া কিছু একটা বলতে নিয়েও বলতে পারলো না। গলা কাপা শুরু হয়েছে ওর। মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। আরাধ্যর অবাক চাহনি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দুষ্ট চাহনিতে রুপ নিল। ধীর পায়ে আরাধ্য স্পর্শিয়ার দিকে এগিয়ে এল। আরাধ্য যত আগাচ্ছে স্পর্শিয়া ততো পিছ পা হতে লাগলো। এক পর্যায়ে দেয়ালের সাথে লেগে যায় ও। আর কোন উপায় না পেয়ে স্পর্শিয়া কাপাকাপা কন্ঠে বলল,
– আ..আ..আন্টি তোমাকে ডাকতে বলেছিল তাই এসেছিলাম।
– আমাকে এভাবে রাক্ষসের মতো দেখছিলে কেন?
– রাক্ষসের মতো?
স্পর্শিয়া চোখ তুলে আরাধ্যর দিকে তাকালো।
– হ্যা। মনে হচ্ছিল এখনি খেয়ে ফেলবে।
স্পর্শিয়া নিশ্চুপ। কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না।

আরাধ্য ওর হাত ছোয়াল স্পর্শিয়ার গলায়৷ আরাধ্যর ঠান্ডা হাতের স্পর্শে স্পর্শিয়ার সারা শরীর কেপে উঠলো। স্পর্শিয়ার গলা থেকে পেট পর্যন্ত আরাধ্য হাত ছুইয়ে দিল৷ স্পর্শিয়া আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেললো। আরাধ্য স্পর্শিয়ার গলায় আলতো করে চুমু দিল, কানে কামড় দিল। স্পর্শিয়ার চুলের ভেতর হাত গুজে গালে, কপালে চুমু খেল। জড়িয়ে ধরলো আরাধ্য স্পর্শিয়াকে। নিজের সারা শরীরে এক শীতল অনুভূতি হলো স্পর্শিয়ার। স্পর্শিয়াও আরাধ্যর ভেজা পিঠে হাত দিয়ে ওকে জাপটে ধরলো। আরাধ্য স্পর্শিয়ার গলার ওড়না ধরে টান দিতেই স্পর্শিয়া চোখ খুলে ওড়না ধরে ফেললো। আরাধ্যকে আস্তে করে ধাক্কা দিয়ে বলল,
– কি করছ তুমি?
– আমার বউকে আদর করছি।
– আর করা লাগবে না আদর৷ সরো। তোমাকে আন্টি ডাকছে৷ যাও।
– যাব না।
– না গেলে নেই। আমি চলে যাচ্ছি।
– অসম্ভব। তুমি আমার ইজ্জত লুটে নিয়ে এখন চলে যাচ্ছ!
স্পর্শিয়া চোখ বড় বড় করে বলল,
– ইজ্জত লুটেছি মানে?
– এই যে, আমাকে এভাবে দেখে ফেললে।
– তুমি আমার সামনে এভাবে এসেছ কেন? তোমার দোষ।
– বললেই হলো নাকি আমার দোষ। আমি কি দেখেছিলাম নাকি যে তুমি এখানে এসেছ? তুমিই তো এখানে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছিলে। সুযোগ বুঝে আমার সব দেখে নিলে। আর উল্টো আমাকেই দোষারোপ কর?
– তোমার এসব দেখার আমার কোন ইচ্ছা নেই, সরো।
– তাহলে তখন তাকিয়ে তাকিয়ে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত কি দেখছিলে, হুম?
স্পর্শিয়া কোন উত্তর দিতে না পেরে চুপ করে রইলো।
– আমি কিছু জানি না। তুমি আমাকে যেভাবে দেখেছ, আমিও তোমাকে সেভাবেই দেখবো।
স্পর্শিয়া চোখ এত বড় বড় করল মনে হচ্ছিল যে এখনি বিস্ফোরণ হবে।
– কি বললে তুমি?
– আর নয়তো কি? তুমি আমার ইজ্জত দেখে ফেলেছ। ছেলে মেয়ে সমান অধিকার। আমি আমার অধিকার চাই ই চাই৷
আরাধ্য স্পর্শিয়ার হাত ধরতেই ও আরাধ্যকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দৌড় দিল।
.
.
.
.
.
.
.

আরাধ্য স্পর্শিয়াকে খুজছে। ওকে এভাবে ফেলে দিয়ে মেয়েটা গেল কই?

খুজতে খুজতে বাড়ির পিছনে চলে গেল আরাধ্য। স্পর্শিয়াকে দেখে তো ও রিতীমত অবাক। ও বাড়ির পিছনে এসে গ্রামের ছোট বাচ্চাদের সাথে কুতকুত খেলায় যোগ দিয়েছে। আরাধ্যর দেখা প্রথম কোন মেয়ে স্পর্শিয়া যে হাজবেন্ডের নানুবাড়ি এসে কুতকুত খেলছে তাও বাচ্চাদের সাথে । আরাধ্য লুকিয়ে বেশ কয়েকটা ছবি তুলে ফেলল। যেভাবে বাচ্চাগুলোর সাথে খেলছে ও, ওকে কেও দেখলে এটাই ভাববে যে এই বাচ্চাগুলো ওর বন্ধুবান্ধব। এই পিচ্চি মেয়েটার প্রেমে ও কি করে যে পড়ে গেল নিজেই ভেবে পায় না। স্পর্শিয়া খেলতে খেলতে ঝগড়া লেগে গিয়েছে বাচ্চাগুলোর সাথে। কেন ঝগড়া লেগেছে আরাধ্য বুঝতে পারলো না। আরাধ্য স্পর্শিয়ার ঝগড়া দেখে জোড়েই হেসে দিল। হাসির শব্দ পেয়ে আরাধ্যর দিকে তাকাতেই স্পর্শিয়া ঝগড়া থামিয়ে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। আরাধ্য হাসি থামিয়ে স্পর্শিয়ার সামনে আসলো। আরাধ্যকে সামনে আসতে দেখে স্পর্শিয়া মুখ গোমড়া করে ফেললো।

– কি ব্যাপার স্পর্শ? তোমার বন্ধুদের সাথে ঝগড়া করছ কেন তুমি?
– আমি তোমার সাথে কোন কথা বলতে চাই না।
– কেন? আমি আবার কি করলাম?
– তুমি খুব খারাপ একটা লোক।
– আমার বউকে আমি একটু আদর করতে চাওয়ায় খারাপ লোক হয়ে গেলাম?
– তুমি তখন কি করতে চাচ্ছিলে?
আরাধ্য মুচকি হেসে বলল,
– কি করতে চেয়েছি?
– তুমি… তুমি তখন.. তখন… যাও। বলব না। বলার মুড নেই৷
– তাহলে কিসের মুড আছে?
– তোমাকে মারার মুড। আমি কথা বলব না তোমার সাথে।
– তুমি আমার ইজ্জত লুটে নিলে, আর আমি একটু দেখতে চাওয়াতেই এত রাগ আমার উপর?
– হুহ। পচা বেটা তুমি। আবারও পচা কথাই বলছো।
– আরে বাবা। আমি তখন মজা করছিলাম, ট্রাস্ট মি। তোমার আরাধ্যকে কি তোমার এমন মনে হয়?
স্পর্শিয়া খুব জোড়ে না সূচক মাথা ঝাকালো।
– তাহলে এই ট্রাস্ট টা রেখ।
– হুম।
– তারপর বলো, ঝগড়া করছিলে কেন বন্ধুদের সাথে?
– ওরা আমার সাথে চিটিং করেছে তাই।
এরমধ্যেই এক পিচ্চি এসে স্পর্শিয়ার জামা ধরে টেনে বলতে লাগলো,
– এই ইসপরছিয়া, খেলতানা তুমি?
– তোমরা চিটিং কর। আর খেলব না তোমাদের সাথে।
– আর চিটিং করমু না। খেলতে আহো।
স্পর্শিয়া একবার আরাধ্যর মুখের দিকে তাকালো৷ তারপর খুব হাসি হাসি মুখ করেই ওর সব বাচ্চা ফ্রেন্ডগুলোর সাথে আরাধ্যর পরিচয় করিয়ে দিল। আরাধ্য হাসবে নাকি কাদবে বুঝতে পারছে না। আরাধ্যর নিজের বাচ্চার বয়সী ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলোকে স্পর্শিয়া ওর কাছে বন্ধু হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে। পরিচয় পর্ব শেষ করে স্পর্শিয়া আর থাকলো না। দেড়ি হচ্ছে বলে নিজেই বাসায় চলে এল।
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
আরাধ্য দূরে দাড়িয়ে কাজিনদের সাথে কথা বলছে, আর ঝিনুক একটু পরপর ই আরাধ্যর দিকে তাকাচ্ছে। এটা স্পর্শিয়ার নজড়ে পড়লেও আরাধ্যর নজড়ে পরেনি। খাবার টেবিলেও স্পর্শিয়া খেয়াল করেছে, আরাধ্য যখন ওর মুখে খাবার তুলে দেয়, তখনো এই মেয়ে এভাবেই তাকিয়ে ছিল বেহায়ার মতো, যেন ওর বয়ফ্রেন্ডকে স্পর্শিয়া কেড়ে নিয়ে গেছে । স্পর্শিয়ার ইচ্ছা করছে ঝিনুককে গিয়ে হাতের মধ্যে কামড় দিতে৷ কেমন বেহায়া মেয়েরে বাবা! কালকে জানল যে আরাধ্য এনগেইজড, তারপরেও আজকে কিভাবে লোভাতুর দৃষ্টিতে দেখছে ওকে।

পেছন থেকে পায়েল এসে ডাক দিতেই না চাওয়া সত্ত্বেও আরাধ্যকে চোখের আড়াল করতে হলো স্পর্শিয়ার। যখন ফিরে এল, দেখে আরাধ্য আশেপাশে নেই। এমনকি ঝিনুকও নেই। স্পর্শিয়ার বুকটা কোন এক অজানা ভয়ে ধুকধুক করতে লাগলো। ওরা কোথায় গেল? কেও নেই কেন? কি করছে ওরা? কোথায় আছে? এসব ভাবতে ভাবতেই মাথা ধরে গেল ওর। আর না পেরে এদিক সেদিক খুজতে লাগলো আরাধ্যকে। একটু পরেই আরাধ্য ওর সামনে এসে হাজির৷ স্পর্শিয়ার চোখে পানি টলটল করছে। যে কোন মুহূর্তে গড়িয়ে পড়বে৷
– আমাকে খুজছো তুমি?
স্পর্শিয়া এতই ভয় পেয়ে গিয়েছিল যে মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না।
– তুমি মনে করেছিলে আমি ঝিনুকের সাথে কোথাও গিয়েছি, তাই না?
স্পর্শিয়া এখনো নিশ্চুপ।

আরাধ্য স্পর্শিয়ার দুই হাত ধরে বলল,
– আমি তোমার বিশ্বাস কখনো ভাঙবো না। ঝিনুক যে বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিল সেটা আমিও দেখেছি। এমনকি ঝিনুক আমার সাথে কথাও বলতে চেয়েছিল, কিন্তু আমি ওকে ইগনোর করেছি৷ কারণ, যাকে আমার স্পর্শ পছন্দ করে না, তার সাথে কথা বলার তো কোন দরকার নেই আমার। আমার ফার্স্ট প্রায়োরিটি তো তুমি। অন্য কেও না।
স্পর্শিয়ার চোখে জমে থাকা পানিটুকু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো। আরাধ্য স্পর্শিয়ার চোখ মুছে দিল৷
– এ্যাই মেয়ে, কাদো কেন এত? সারাদিন শুধু কাদতেই জানো, আদর তো আর করতে জানো না।
– বেহায়া বেটা।
– আর যাই মিস হোক না কেন, আমাকে বেহায়া, লুইচ্চা এসব বলার কোন সুযোগ তুমি কখনোই হাতছাড়া করো না।
– আর, করবোও না। তুমি বেহায়া সেইজন্যই বলি।
– আমার মতো হট একটা ছেলেকে তুমি “বেটা” নিশ্চয়ই বলতে পার না।
– তুমি আমার কত বড়! বেটা না বললে বলবো টা কি? বুইড়া বেটা। সঠিক বয়সে বিয়ে করলে আমার মতো একটা মেয়ে থাকতো তোমার।
– হায় আল্লাহ! এত বড় মিথ্যা কথা! অবশেষে বাবার বয়সী বানিয়ে দিলে।
– তোমাকে নানার বয়সী বানিয়ে দেওয়া দরকার ছিল।

স্পর্শিয়ার কাছে এই বিয়ের সবচেয়ে মজার পার্ট ছিল বউ বিদায় নেওয়ার সময় একটুও কাদেনি। ও তো অবাক চোখে চেয়েছিল। একটুপরে মুখ চেপে চেপে হেসেছিলে বউয়ের চোখে পানি নেই বলে। পারে না জামাই ই কেদে দেয়। অথচ বউয়ের কান্নার কোন নাম ই নেই।
– আরাধ্য দেখ, তোমার নতুন ভাবি কাদছেই না।
একথা বলেই স্পর্শিয়া হাসতে হাসতে কুটিকুটি৷
– তুমিও কাদবে না, আমি জানি৷
– কে বলেছে?
– হ্যা, কারন তুমি তো খুশিতে আমার বাসায় চলে আসবে। এতদিন পরে আমাকে পাবে! তাহলে কাদবে কেন?
স্পর্শিয়ার মন যেন নিমিষেই খারাপ হয়ে গেল।
– এই স্পর্শ, কি হলো তোমার?
– মেয়েদের জীবনটা কেমন না আরাধ্য? নিজের ফ্যামিলি, বাবা মা কে ছেড়ে অন্য একটা অপরিচিত পরিবারকে আপন করে নিতে হয়৷ অথচ যারা তার আপন, তখন তারাই হয়ে যায় পর। আবার সেখানে কিছু কিছু ফ্যামিলি ছেলের বউকে নিজের পরিবারের সদস্যও মানতে পারে না। তাদের কাছে সেই মেয়েটা সারাজীবন “পরের মেয়ে” বলেই আখ্যা পায়। সেই মেয়েটার তখন আর বাড়ি বলতে কিছুই থাকেনা। নিজের বাবার বাড়িও পর হয়ে যায়, আর শ্বশুরবাড়িও তাকে আপন ভাবে না।

এইমূহুর্তে স্পর্শিয়ার কথা শুনে ওকে খুব ম্যাচিউর একটা মেয়ে মনে হচ্ছে। আরাধ্য কিছু বলল না। ওর যা ইচ্ছা বলুক। মনের চাপা কথাগুলো প্রকাশ করুক।
.
.
.
.
.
.
রাতে ওদের কারও ই কিছু বলতে হলো না। দুজনেই সময় মতো বের হয়ে গেল। তিন দিন যাবত স্পর্শিয়ার নিজেকে নিশাচর পাখি মনে হয়। কিন্তু তফাৎটা হচ্ছে ওর ডানা নেই। সত্যিই অন্যরকম, আর সারাজীবন গেথে যাওয়ার মতো মুহূর্ত এগুলো। আরাধ্য যে ওকে কতটা স্পেশাল ফিল করায় তা একমাত্র ও ই জানে।
– স্পর্শ।
– হুম।
– কালকে রাতে যখন তোমাকে ঘুমের মধ্যে কোলে নিয়ে বাসায় ফিরে যাচ্ছিলাম, তুমি আমাকে খুব শক্ত করে জাপটে ধরে রেখেছিলে। আর বারবার বলছিলে “প্লিজ ডোন্ট লিভ মি। আমি শুধু তোমাকে চাই, আর কিছু চাই না। ” আমার এত ভালো লাগছিল জানো? ইচ্ছে করছিল তোমাকে এভাবেই আমার বুকের মধ্যে রেখে সারাটা রাত পার করে দেই। কিন্তু আবার ভাবলাম, আমাকে তো সরাসরি কখনো এমন কিছু বললে না, তাহলে ঘুমের ঘোরে বলছ কেন? চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম, কথাগুলি আমার জন্য ছিল নাকি অন্য কারও জন্য।
একথা বলেই আরাধ্য হো হো করে হেসে উঠলো। স্পর্শিয়ার কলিজা ছেদ হয়ে গেল সেই হাসিতে। আরাধ্যর কথা শুনে ওর এতক্ষনে মনে পড়লো ও গত রাতে সায়ানকে স্বপ্নে দেখেছ। আর ঘুমের ঘোরেই এসব বলছিল স্বপ্ন দেখে। স্নিগ্ধাও ওকে বেশ কয়েকবার বলেছিল ও ঘুমের মধ্যে সায়ানকে নিয়ে অনেক কিছুই বলে। স্পর্শিয়ার বুকটা আতঙ্কে ছটফট করছে৷
আরাধ্য স্পর্শিয়ার দিকে তাকাতেই আরাধ্যর চেহারা মলিন হয়ে গেল।
– স্পর্শ, আমি মজা করে বলছিলাম কথাটা। তুমি সিরিয়াসলি নিয়ে মন খারাপ করে আছ কেন? আমি জানি তুমি ঘুমের ঘোরে যা বলেছ আমার জন্যই বলেছ৷ প্লিজ মন খারাপ করো না।
স্পর্শিয়া কাপা কাপা গলায় বলল,
– আরাধ্য, আমি ঘুমের ঘোরে যা বলেছি তা তোমার জন্য বলিনি।
স্পর্শিয়ার কথা শুনে আরাধ্যর চোখমুখ মূহুর্তের মধ্যে শক্ত হয়ে গেল৷

(চলবে)

লিখা: Dewan Oishi

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here